রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ গোটা বিশ্বকে নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের ওপরও এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। ‘অর্ডার (ক্রয় আদেশ)’ কমে যাওয়ায় তৈরি পোশাকশিল্প ধুঁকছে। আর্থিক সংকটে এক বছরে চট্টগ্রামের ১২টি গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
গার্মেন্ট শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তৈরি পোশাকশিল্প ঘুরে দাঁড়ালেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন। বৈশ্বিক মন্দায় ক্রয় আদেশ কমতে শুরু করেছে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী সেলস ও মার্কেটিং টিমকে কাজে লাগিয়ে কিছু অর্ডার পেলেও মাঝারি আকারের প্রতিষ্ঠানগুলো পাচ্ছে না।
এ কারণে এ ধরনের কারখানাগুলোকে ভুগতে হচ্ছে বেশি। কোনো কোনো কারখানা উৎপাদন-সক্ষমতার অর্ধেক অর্ডারও পাচ্ছে না। ব্যবসায় টিকে থাকতে না পেরে অনেক কারখানা লোকসানি ও রুগ্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার পথে। এক বছরে আর্থিক সংকটে চট্টগ্রামের ১২টি গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আরও বেশ কয়েকটি কারখানা বন্ধের পথে। আবার কোনো কোনো গার্মেন্ট কারখানা কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনছে। গার্মেন্ট কারখানা সাময়িক লে-অফও করতে হচ্ছে। আবার শ্রমিকদেরও নিয়মিত বেতন দিতে হচ্ছে।
এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে তৈরি পোশাকশিল্পের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পোশাক তৈরি ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিস সূত্র জানায়, বর্তমানে চট্টগ্রামে বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা ৬২২টি। এর মধ্যে লোকসানসহ নানা কারণে বিভিন্ন সময় ২৮৮টি বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া প্রতিবছর ১০-১৫টি করে গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কারখানার উৎপাদন অনিয়মিত হয়ে পড়লেও ব্যাংক-বিমা কোম্পানিসহ পাওনাদারদের চাপের শঙ্কায় সেগুলো কোনোমতে চালু রাখা হয়েছে।
নগরীর কাট্টলী এলাকার কাট্টলী টেক্সটাইল লিমিটেডের হেড অব অপারেশন্স শহীদ উল্যাহ যুগান্তরকে বলেন, নভেম্বরের শেষ দিক থেকে অর্ডার ব্যাপক হারে কমতে শুরু করে। এখনো অর্ডার কমছে। সক্ষমতার অর্ধেক অর্ডারও মিলছে না। তাই শ্রমিকদের প্রায় বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। কয়েক মাস ধরে লোকসান দিয়ে কারখানা চালু রাখা হয়েছে। এভাবে কতদিন টিকে থাকা যাবে, তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। তিনি আরও জানান, বর্তমান সংকট কাটাতে বিজিএমইএ নেতারা বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছেন। সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছেন। তাই আশা করা যায়, আগামী জুন-জুলাই থেকে অর্ডার বাড়তে পারে এবং চলতি বছরের শেষ নাগাদ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে পারে। সেই সুদিনের আশায় ব্যবসায়ীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি গার্মেন্ট কারখানার এক কর্মকর্তা জানান, প্রতি মাসে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন বাবদ কোটি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে যে অর্ডার পাওয়া যাচ্ছে তাতে কাঙ্ক্ষিত আয় হচ্ছে না। অথচ মাসে অর্ধকোটি টাকারও বেশি ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। পরিস্থিতি ‘খুবই খারাপ’ উল্লেখ করে বিজিএমইএ সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, আমরা হিসাব করে দেখেছি-কারখানাগুলোর সক্ষমতার ৪০-৫০ শতাংশ অর্ডারও পাওয়া যায়নি। কেউ কারখানা বন্ধও করে দিচ্ছে। কেউ কেউ কর্মঘণ্টা কমাচ্ছেন। দুপুরের মধ্যেই কেউ কেউ ছুটি দিয়ে দিচ্ছে।
বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটে গার্মেন্ট শিল্পের রপ্তানি আদেশ কমেছে। তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ গোটা বিশ্বকে এক নাজুক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। যে ইউরোপকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধিশালী বলা হয়, সেই ইউরোপেও এর প্রভাব পড়েছে। ইইউভুক্ত দেশগুলোতে (যুক্তরাজ্যসহ) আমাদের পোশাক রপ্তানির ৬০ শতাংশ হয়। বাকি বাজার হলো আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলো।
সৈয়দ নজরুল আরও বলেন, মুদ্রাস্ফীতির আগুনে জ্বলছে পশ্চিমের অর্থনীতিও। সেখানকার মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও চাহিদা কমেছে। এ কারণে রপ্তানি আদেশের পরিমাণও কমছে। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা, সময়মতো ব্যাংক-বিমার দায় পরিশোধ, বিভিন্ন ধরনের বিল পরিশোধসহ কারখানা চালু রাখা, সর্বোপরি কোনোরকমে টিকে থাকা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তাই যা কিছু অর্ডার পাওয়া যাচ্ছে তাই নিয়ে কারখানা চালু রাখার চেষ্টা চলছে। নতুন অর্ডারের ক্ষেত্রে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলার ব্যাপারে ডলার সংকট পুঁজি করে নানা হয়রানি ও ব্যাংকগুলোর গড়িমসি চলছে। অন্যদিকে বর্তমানে উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে।