পোশাকের ব্যবসায় কাপড়ের রং ওঠা বন্ধে মাটির কাছেই ফিরে গেলেন কারুশিল্পী জগদীশ চন্দ্র রায়। সফলও হয়েছেন তাতে। কাপড়ের রঙের স্থায়িত্ব দিতে তিনি ব্যবহার করছেন কালো, সাদা ও লাল মাটির সঙ্গে বিভিন্ন উদ্ভিজ্জ বা ভেষজ উপকরণ। পরে সেই কাপড় দিয়েই তৈরি করেন হরেক রকমের পোশাক।
এই উদ্যোক্তা জানান, তিনি এখন ফতুয়া-পাঞ্জাবি থেকে শুরু করে শাড়ি, থ্রি-পিস, বিছানার চাদর, পর্দা, রানার, কুশন কাভার, বড় ব্যাগ, হাতব্যাগ, জুতাসহ ১০টির বেশি পণ্য বানিয়ে পাইকারি ও খুচরা দুভাবেই বিক্রি করেন। সম্পূর্ণ তৈরি পণ্যের পাশাপাশি কাপড় গজ হিসেবেও বিক্রি করেন তিনি।
ঠাকুরগাঁওয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ১৯৯৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের কারুশিল্প বিভাগে ভর্তি হন জগদীশ চন্দ্র রায়। পড়ার বিষয়কেই পরবর্তী সময়ে পেশা হিসেবে নেন তিনি। প্রতিষ্ঠা করেন ‘টি গাঁও কারুশিল্প’ নামের প্রতিষ্ঠান। তাঁর এ প্রতিষ্ঠানে এখন কাজ করছেন ১৫ জন কর্মী।
এই ব্যবসায়ে জগদীশ চন্দ্র রায়ের প্রাথমিক বিনিয়োগ ছিল মাত্র ১০ হাজার টাকা। তবে সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত তিনি বিনিয়োগ করেছেন প্রায় ৩৫ লাখ টাকা। গত বছর শুধু পাইকারি পর্যায়ে প্রায় ১৯ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেছেন তিনি। রাজধানীর শ্যামলীর আদাবর থানা এলাকায় তাঁর একটি বিক্রয়কেন্দ্রও রয়েছে। এ ছাড়া অনলাইনেও পণ্য বিক্রি করেন এই উদ্যোক্তা।
সম্প্রতি সাভারের হেমায়েতপুরে অবস্থিত টি গাঁও কারুশিল্পের কারখানায় প্রথম আলোর সঙ্গে নিজের পথচলার গল্প শোনান উদ্যোক্তা জগদীশ চন্দ্র রায়। তিনি জানান, কৃষক পরিবারের সন্তান হওয়ায় মাটি ও প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছোটবেলা থেকেই। নাটক আর আঁকা আঁকি তাঁর পরিবারের ঐতিহ্য। এ সবই জগদীশকে এই পেশায় আসতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
জগদীশ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার সময় বাটিক ও আঁকাআঁকি নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হতো তাঁকে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজের কাজ দেখানোর প্রথম সুযোগ পান ২০০৫ সালে। সে বছর পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে পাঁচ বন্ধু মিলে চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে একটি প্রদর্শনীতে অংশ নেন। তাতে তিনি প্রদর্শন করেন বাটিকের শার্ট ও ফতুয়া। নকশা সুন্দর হওয়ায় ওই শার্ট ও ফতুয়া বেশ প্রশংসিত হয়। তবে কেউ কেউ কাপড়ের রং উঠে যাওয়ার অভিযোগ করেন।
জগদীশ তখন প্রাকৃতিক কোনো প্রক্রিয়া অনুসরণের কথা ভাবলেন, যা কাপড়ের রং ওঠা ঠেকাবে। এ নিয়ে তিনি গবেষণা শুরু করেন। এ সময় তিনি একটি অ্যানিমেশন প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন কাজও করতেন। এরই মধ্যে ২০০৮ সালে একটি শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় পড়তে যান জগদীশ। সেখানে পোশাকের নকশা ও বিভিন্ন ধরনের বাটিকের কাজ শেখেন। দেশে ফিরে মনস্থির করেন, বড় পরিসরে কাজ করবেন।
এরপর ২০১৫ সালে ঠাকুরগাঁওয়ে ফিরে যান জগদীশ। প্রতিষ্ঠা করেন টি গাঁও কারুশিল্প নামের প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠান থেকে শুরুতে কাঠের ওপরে বাটিক করে শোপিস বানাতে শুরু করেন। পরে কাপড়ের বাটিকের কাজে হাত দেন। কাজের সুবিধার জন্য বছরখানেক পর কারখানা সরিয়ে আনেন সাভারের হেমায়েতপুরে। জগদীশ জানান, শুরুতে কেমিক্যাল বা রাসায়নিক ডাইং ব্যবহার করেছিলেন। পরে ভেষজ রঙের মাধ্যমে বাটিকের কাজে হাত দেন। কাপড়ে কালো মাটির ডাইং শুরু করেন ২০২০ সালের শুরুতে।
কালো মাটি ও ভেজিটেবল ডাইং বেছে নেওয়া প্রসঙ্গে জগদীশ বলেন, উদ্ভিজ্জ যেসব উপকরণে কষ জাতীয় উপাদান রয়েছে, সেগুলো দিয়ে তৈরি করা রং বেশি স্থায়ী হয়। যেমন হরীতকীর রং সহজে উঠে না। এর সঙ্গে যোগ হয় কালো মাটির কৌশল (ভূমির উপরিভাগ থেকে ৮-১০ ফুট নিচে আঠালো ধরনের যে কালচে মাটি পাওয়া যায়)।
জগদীশ চন্দ্র রায় বলেন, রং করার প্রক্রিয়াটি কয়েক ধাপে করতে হয়। প্রথমে পরিষ্কার কাপড় কিনে এনে সেটাকে প্রাকৃতিক উপায়ে মাড়মুক্ত করা হয়। এরপর হরীতকী বা খয়ের ইত্যাদি উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে প্রাথমিক রং করে কাপড় শুকানো হয়। পরে তাতে কালো কিংবা লাল অথবা সাদা মাটির সঙ্গে লোহার জং বা মরিচা মিশিয়ে কাপড়ে পেস্ট করে রাখা হয়। নির্দিষ্ট সময় পরে কাপড় ধুয়ে নিলে মাটি উঠে যায়, আর জং বা মরচের দাগটা কাপড়ে লেগে থাকে। এতে কাপড়ে নকশা তৈরি হয়।
তবে খাওয়ার হলুদ, গাঁদা ফুল, ডালিমের খোসা, নীল (ইনডিগো), খয়ের থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে পাওয়া বিভিন্ন রং ব্যবহার করেও কাপড় আর পোশাকের নকশায় বৈচিত্র্য আনা যায় বলে উল্লেখ করেন জগদীশ। বলেন, এসব রং শরীরের জন্য সহনশীল এবং পরিবেশের জন্যও উপযোগী।
কারুশিল্পী ও উদ্যোক্তা জগদীশ চন্দ্র জানান, এই কাজ মোটামুটি সময়সাপেক্ষ। কাঁচামালগুলো আগে থেকে প্রস্তুত রাখতে হয়। এতে খরচ বেশি হয়। রাসায়নিক ডাইংয়ের তুলনায় ভেষজ ডাইংয়ের কাপড় তৈরিতে খরচ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এখন এই খরচ কমিয়ে আনা নিয়ে কাজ করছেন বলে জানান তিনি। বলেন, ‘খরচ কমানোর একটি উপায় হলো উৎপাদন বাড়ানো। এ জন্য যন্ত্রচালিত স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে যাওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি।’
জগদীশ চন্দ্র রায় বলেন, ‘বাংলাদেশে কাদা মাটির ডাইং করা কাপড়ের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও এর চাহিদা রয়েছে। আমি চাই, গ্রামের মানুষও এ ধরনের প্রযুক্তি শিখুক।’