শুধু বাংলাদেশিরাই নয়, পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলংকা এবং ভিয়েতনামের নাগরিকেরাও রোমানিয়া থেকে পালিয়ে প্রতিবেশি দেশগুলোতে চলে যাচ্ছে।
ছবি-সংগৃহীত
ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচ্চ আয়ের দেশ রোমানিয়া বাংলাদেশি অভিবাসীদের জন্য এমন একটি গন্তব্যে পরিণত হয়েছে যেখানে তারা তাদের ইউরোপে যাবার স্বপ্ন ক্রমশ ধূলিসাৎ হতে দেখছে। কারণ তাদের সেখানে পাঠানো হচ্ছে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি আর প্রতারণার মাধ্যমে।
ফেব্রুয়ারিতে শফিকুর রহমান (ছদ্মনাম) একটি নির্মাণ কোম্পানিতে মাসিক ৬০৫ ইউরো বেতনের চুক্তিতে রোমানিয়ায় আসেন। কিন্তু আসার সাথে সাথেই বুঝতে পারেন প্রতারণা করা হয়েছে তার সাথে! রোমানিয়ায় সে নামে কোনো কোম্পানিই নেই।
“আমি এখানে এসে কোম্পানির কোনো হদিসই করতে পারলাম না। যে দালালের মাধ্যমে এসেছি তারাও এখন আমার ফোন ধরছে না। আমার মনে হচ্ছে যে, আট লাখ টাকা খরচ করে এসে আমি প্রতারণার শিকার হয়েছি। আমি চাই এভাবে আর কেউ এখানে না আসুক”, বলেন শফিকুল।
পরে ৪৮৪ ইউরোর বিনিময়ে অন্য একটি কাজের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হোন এই ২৭ বছরের তরুণ।
টিবিএসকে ফোনে শফিকুর বলেন, “অন্য একজন বাংলাদেশির সহায়তায় বর্তমানের কাজটা না পেলে এখানে খেয়ে-পরে থাকাটাই কঠিন হয়ে যেত।”
রোমানিয়ায় বাংলাদেশি অভিবাসীদের মধ্যে থেকে এ ধরনের গল্প হরহামেশাই শোনা যায়। এদের অনেকেই পরে জোরপূর্বক ইতালি, ফ্রান্স এবং জার্মানির মতো অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের পথ ধরে।
“আমি অন্তত ২০০ কেস হ্যান্ডেল করেছি যেখানে বাংলাদেশি শ্রমিকরা গিয়ে কাজ পায়নি বা বেতন কম পাচ্ছে। এ কারণে শুধু বাংলাদেশিরাই নয়, পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলংকা এবং ভিয়েতনামের লোকেরাও রোমানিয়া থেকে পালিয়ে প্রতিবেশি দেশগুলোতে চলে যাচ্ছে”, বলেন রোমানিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ইসলাম মোহাম্মদ রফিকুল।
রোমানিয়াগামী অনেক অভিবাসী প্রাইভেট এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছে কারণ তারা একেকজন অভিবাসীর কাছ থেকে মাথাপিছু ৬-৮ লাখ টাকা চার্জ করছে; অথচ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মতে, সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসেল) এক্ষেত্রে নিয়ে থাকে মাত্র ২ লাখ ৩১ হাজার টাকা।
চলতি বছর অভিবাসী প্রেরণ শুরুর পর বোয়েসেল এখন পর্যন্ত মাত্র ২০০ জনকে রোমানিয়ায় পাঠিয়েছে; অথচ রোমানিয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের তথ্য বলছে, গত আড়াই বছরে প্রায় ১৮ হাজার বাংলাদেশি দেশটিতে গেছে।
বোয়েসেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ড. মল্লিক আনোয়ার হোসেন টিবিএসকে জানান, সংস্থাটি এ বছরই রোমানিয়াতে অভিবাসীদের পাঠানো শুরু করেছে।
তিনি বলেন, “একটা মার্কেট প্রমোট করতে সময় লাগে। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সব সময় অল্প কর্মী পাঠিয়ে কীভাবে বেশি রেমিটেন্স আনা যায়, সেদিকেই আমাদের ফোকাস।”
এদিকে রোমানিয়ায় বাংলাদেশের দূতাবাস অভিবাসীদের এমন দুর্দশার জন্য নিয়োগকারী সংস্থাকে দায়ী করেছে। যদিও জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস (বায়রা) এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
রোমানিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোঃ দাউদ আলী বলেন, “একটা গ্রুপ আছে যারা মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আসে অন্য দেশে পালিয়ে যাওয়ার জন্য। আর রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো তাদেরকে উৎসাহিত করে। যে বেশি পয়সা দেয়, তারা তার ফাইল প্রসেস করে।”
চুক্তি অনুযায়ী বেতন না পাওয়ার জন্যও এজেন্সিগুলোকে দায়ী করে তিনি বলেন, “চুক্তিনামায় মূলত গ্রস স্যালারি লেখা থাকে। কিন্তু গন্তব্যে এসে ওরা নেট স্যালারিটা পায়, যা মূল বেতনের চেয়ে হয়ত ৫০০ লেই (রোমানিয়ান মুদ্রা) কম। কিন্তু এ বিষয়টি এজেন্সিগুলো কর্মীদের ক্লিয়ার করে না।”
অভিবাসীদের প্রতিশ্রুত কাজ না পাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “কর্মী পাঠানোর আগে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংশ্লিষ্ট নিয়োগকর্তার ডিমান্ড লেটারগুলো লিগ্যাল চ্যানেলে ভেরিফাই করার কথা। কিন্তু তারা তা করে না।”
এ ধরনের এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তার কার্যালয় বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোকে (বিএমইটি) চিঠি দিয়েছে বলে জানান রাষ্ট্রদূত।
রিক্রুটিং এজেন্সি ইনফিনিটি এইচসিএম-এর সিইও সিরাজুল আমিন টিবিএসকে বলেন, “আমরা এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ ওয়ার্কার পাঠিয়েছি। কিন্তু কোনো অভিযোগ আসেনি। এর কারণ হলো মূলত প্রফেশনাল এজেন্সিগুলোর মধ্যে আমাদের মতো মাত্র ৪-৫টা এজেন্সি লোক পাঠাচ্ছে।”
“রোমানিয়াতে ৪-৫ বছর আগে যেসব বাংলাদেশি গিয়েছিল তাদের মধ্যে অনেকে দালালের মাধ্যমে সেখানে কর্মী নেয়া শুরু করেছে। এরা যে কোনো একটা বাংলাদেশি এজেন্সি ধরে বিএমইটি থেকে শুধু ম্যানপাওয়ার অ্যাপ্রুভালটা আদায় করে নেয়।”
“মূলত এসব কারণেই বেশিরভাগ কর্মী এজেন্সিগুলোর নামও জানে না । কারণ এজেন্সির সম্পৃক্ততা খুবই কম, মূলত দালালরাই সব”, যোগ করেন তিনি।
তবে শুধু এজেন্সিকে দায়ী করা একটা দায়িত্বহীনতা উল্লেখ করে বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, “প্রথমত রোমানিয়া থেকে পালিয়ে যাওয়া একটা ট্রেন্ড হয়ে গেছে। যারা যায়, তাদের অনেকের বিভিন্ন ধরণের লিংক আছে প্রতিবেশি দেশগুলোতে।”
“সব এজেন্সি ভালো এমনটা আমরা দাবি করছি না। তবে অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট এজেন্সির বিরুদ্ধে বিএমইটিতে জানাতে পারে।”
অভিবাসীর সংখ্যা
গত আড়াই বছরে প্রায় ১৮ হাজার বাংলাদেশি রোমানিয়ায় গেলেও বাংলাদেশ দূতাবাস বর্তমানে রোমানিয়ায় বসবাসকারীদের সঠিক সংখ্যা জানাতে পারেনি।
তবে চেম্বার অব কমার্স রোমানিয়া-বাংলাদেশের অনুমান, এ মুহূর্তে সেখানে বাংলাদেশিদের সংখ্যা ৬ হাজারের বেশি হবে না।
যারা থেকে গেছে
২০১৯ সালে রোমানিয়ায় যান ময়মনসিংহের ফয়জুল ইসলাম। এ পর্যন্ত একাধিকবার চাকরি পরিবর্তন করলেও কখনও দেশটিতে নিয়োগকর্তাদের সাথে বেতন নিয়ে ঝামেলায় পড়েননি তিনি।
“আমি এখানে থাকা-খাওয়া বাদ দিয়ে ৬০ হাজার টাকা বাড়িতে পাঠাতে পারছি”, বলেন ফয়জুল।
তার মতে, রোমানিয়ায় আসা বাংলাদেশিদের ২০% ভালো করছে, কিন্তু বাকিরা ভালো অবস্থায় নেই; তারা অন্য দেশে চলে যাচ্ছে।
সম্প্রতি ঢাকা সফরে আসা চেম্বার অব কমার্স রোমানিয়া-বাংলাদেশের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল স্ট্যানেস্কু টিবিএসকে বলেন, “বেতন-সুবিধা ভালো দেখে রোমানিয়ানরা জার্মানি, ইতালি বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশে চলে যায়। বিদেশি শ্রমিকরাও একইভাবে ভাল বেতনের আশায় রোমানিয়া ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।”
পাশাপাশি রোমানিয়ান নিয়োগকর্তারা চুক্তি অনুযায়ী পারিশ্রমিক প্রদান করেন না, এমন অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
তবে তিনি স্বীকার করেছেন, একাধিক রোমানিয়ান নিয়োগকর্তা এবং বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে এক ধরনের সংযোগ রয়েছে।
তিনি বলেন, চুক্তিতে উল্লেখিত বেতনের চেয়ে কম বেতন প্রদানের একটি কারণ হলো বাংলাদেশি সংস্থাগুলো নিয়োগকারীদের কাছ থেকে কমিশন পায়।
বিএমইটির মহাপরিচালক মোঃ শহিদুল আলম টিবিএসকে বলেন, “আমরা কোনো এজেন্সির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাইনি। বরং আমরা পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাচ্ছি।”
ঢাকা ছেড়েছে রোমানিয়ান অফিস
এদিকে ঢাকাস্থ রোমানিয়ার অস্থায়ী অফিসটি নয়াদিল্লিতে রোমানিয়ান দূতাবাসে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। গত ৯ এপ্রিল কর্তৃপক্ষের জারি করা এক বিবৃতিতে বলা হয়, সেখান থেকেই এটি বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভিসার আবেদনগুলো পরিচালনা করবে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এই স্থান পরিবর্তনের একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে যে, রোমানিয়া ইস্যুকৃত ভিসার সংখ্যা কমানোর চেষ্টা করছে।
অন্যদিকে, রোমানিয়ার একটি সূত্র টিবিএসের কাছে অভিযোগ করে বলে, বিএমইটি ভবনে থাকা রোমানিয়ার অস্থায়ী দপ্তরটি স্থানান্তর করা হয়েছে কারণ বিএমইটি কর্মকর্তাদের কয়েকজন অতিরিক্ত (অ্যাডিশনাল) ভিসার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে বিএমইটির ডিজি শহিদুল আলম টিবিএসকে বলেন, “আমি নিজে কখনো তাদের অফিসে ঢুকিনি। কেন অফিসটিকে স্থানান্তর করা হয়েছে তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে।”
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইস্টার্ন ইউরোপ উইংয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ফোন করা হলেও কোনো উত্তর মেলেনি।