নারকেলের ছোবড়ায় তৈরি ‘স্লিপারের’ প্রথম ইউরোপ যাত্রা

‘ডাব’ না পাড়লে কী হয়? উত্তরটা সহজ, ‘নারকেল’। যা দিয়ে পিঠাপুলি তৈরি, তেল উৎপাদনসহ আছে নানা ব্যবহার। তবে নারকেলের বাইরের অংশ ছোবড়া বেশির ভাগ সময় হয় ফেলে দেওয়া হতো, নয়তো জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতেন কেউ কেউ। নারকেলের সেই ছোবড়া দিয়ে এখন তৈরি হচ্ছে কয়ার ফেল্ট, কোকো পিট, একবার ব্যবহার্য হোটেল স্লিপারের (একধরনের পাদুকা) মতো পণ্য। নারকেলের ছোবড়ার আঁশ ও গুঁড়া দিয়ে তৈরি এসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে, আসছে বৈদেশিক মুদ্রা।

যন্ত্রে তৈরি তোশকের (ম্যাট্রেস) ভেতরের অংশ বা কয়ার ফেল্ট দিয়ে নারকেলের ছোবড়ার বিদেশযাত্রার যে ‍সূচনা হয়েছিল, এক দশকের মধ্যে সেই তালিকায় যুক্ত হয় ‘কোকো পিট’। এবার নারকেলের ছোবড়া দিয়ে তৈরি একবার ব্যবহৃত হোটেল স্লিপার রপ্তানি শুরু হয়েছে। পাশাপাশি বাচ্চাদের জন্য কাঠের তৈরি সাইকেল, পোষা প্রাণীর খেলনাসহ নারকেলের ছোবড়ার তৈরি আরও বেশ কিছু নতুন ধরনের পণ্যের ক্রয়াদেশ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। যদিও এখনো এসব পণ্যের রপ্তানি শুরু হয়নি।  

প্রায় দুই দশক ধরে নারকেলের ছোবড়া দিয়ে উদ্ভাবনী পণ্য তৈরির কাজটি করছে ন্যাচারাল ফাইবার নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বাগেরহাটের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) শিল্পনগরীতে দুই সহোদর মোস্তাফিজ আহমেদ (৫৬) ও মোজাহিদ আহমেদ (৫৩) গড়ে তুলেছেন এই কারখানা। কারখানাটি বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো স্লিপার রপ্তানি করেছে গ্রিসে। বিশ্বের বিভিন্ন তারকা মানের হোটেলে এ ধরনের স্লিপার এখন হামেশা দেখা যায়।

শুরুর কথা

১৯৮৪ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ব্যবসা শুরু করেন মোস্তাফিজ আহমেদ। প্রথম জীবনে নারকেল তেলের কারখানা ছিল তাঁর। এই কারখানার জন্য বাগেরহাট ছাড়াও আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে আনা হতো প্রচুর নারকেল। শুকনো মৌসুমে ছোবড়া তখন জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তবে বর্ষায় এ ছোবড়া ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। তাই ফেলনা ছোবড়া কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তার কৌশল খুঁজতে থাকেন মোস্তাফিজ আহমেদ। এমন সময় দাম পড়ে যাওয়ায় হঠাৎ করেই তেলের ব্যবসায় ভাটা পড়ে। কী করা যায়, ভাবতে ভাবতে মনস্থির করলেন, নারকেলের ছোবড়া দিয়ে কিছু তৈরি করবেন। তখন পর্যন্ত তাঁর ভাবনায় ছিল ম্যাট্রেসের ভেতরের অংশ ‘কয়ার ফেল্ট’ তৈরি করা। দেশের বাজারের পাশাপাশি শুরু থেকেই রপ্তানি ছিল তাঁর লক্ষ্য। ২০০৫ সালে উৎপাদনের যায় তার কয়াল ফেল্ট তৈরির কারখানা। অপ্রচলিত এই পণ্য রপ্তানির পেছনে আছে দীর্ঘ গল্প। বাগেরহাট বিসিকে নিজের কারখানায় বসে তাই শোনালেন ন্যাচারাল ফাইবারের স্বত্বাধিকারী মোস্তাফিজ আহমেদ।

ছোবড়া থেকে তোশক

নারকেলের ছোবড়া দিয়ে পণ্য তৈরিতে ভারত বরাবরই সিদ্ধহস্ত। তাই ভারতের হরিয়ানা, দিল্লি, কেরালা, তামিলনাড়ু ও ওডিশা চষে বেড়ালেন মোস্তাফিজ আহমেদ। সেখানকার কারখানায় ছোবড়া দিয়ে কয়ার ফেল্ট তৈরির কৌশল দেখলেন। যন্ত্রপাতি কিনতে গিয়ে দেখেন দাম নাগালের বাইরে। শেষে পশ্চিমবঙ্গের এক কারখানার সঙ্গে চুক্তি হয়। সেই কারখানা থেকে কয়ার ফেল্ট তৈরি করে নিয়ে আসতে থাকলেন। পরে কয়েকজন শ্রমিককে নিয়ে যান এবং কাজ শিখিয়ে আনেন বাগেরহাটের এই উদ্যোক্তা।

২০০২ সালে দেশে ফিরে স্থানীয় উপকরণ ও কারিগর দিয়ে কয়ার ফেল্টের যন্ত্রপাতি তৈরি করে ফেলেন মোস্তাফিজ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘উৎপাদন শুরু করতে আমাদের প্রায় তিন বছর লেগে যায়। তবে এর আগেই কয়েকটি ম্যাট্রেসের কারখানা আমাদের ক্রয়াদেশ দিয়ে দেয়। পরে সেটি বাড়তেই থাকে।’

ছোবড়ার আঁশের সঙ্গে রেজিন বা তরল রবার মিশিয়ে প্রথমে পাতলা শিট তৈরি করা হয়। পরে ম্যাট্রেস কোম্পানির চাহিদা অনুযায়ী কয়েকটি শিটকে তাপ ও চাপ দিয়ে ১ ইঞ্চি থেকে সাড়ে ৫ ইঞ্চি পুরুত্বের কয়ার ফেল্ট প্রস্তুত করা হয়।

ছোবড়ার পর ছোবড়ার গুঁড়া

ন্যাচারাল ফাইবার প্রতিষ্ঠানটিকে নারকেলের ছোবড়ার আঁশ সরবরাহ দিতে আশপাশে ছোট ছোট বেশ কিছু কারখানা গড়ে ওঠে। কিন্তু পণ্যটির চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকায় এ ছোট কারখানাগুলোর সরবরাহে চাহিদা মিটছিল না। এ কারণে ২০১৭ সালে তাঁরা নিজেরাই বাগেরহাটের সদর উপজেলার কররী গ্রামে ছোবড়া থেকে আঁশ তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। এ কারখানা করতে গিয়ে নতুন পরিকল্পনা পেয়ে বসে মোস্তাফিজ আহমেদকে। এক হাজার নারকেলের ছোবড়ায় ৮০ কেজি আঁশ পাওয়া যায়। একই সঙ্গে উপজাত হিসেবে পাওয়া যায় ১৬০ কেজির মতো গুঁড়া।

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউএসএআইডির অ্যাগ্রিকালচার ভ্যালু চেইন (এভিসি) প্রজেক্টের আওতায় জার্মানের ফ্রাঙ্কফুর্ট ফেয়ারে অংশ নেন মোস্তাফিজ। সেখানে তিনি গিয়েছিলেন মূলত কয়ার ফেল্টের ক্রেতা খুঁজতে। সেখানেই প্রথম বিশ্ববাজারে ‘কয়ার পিটের’ চাহিদার বিষয়ে জানতে পারেন তিনি। কয়ার পিট ব্যবহৃত হয় সাধারণত গবাদিপশুর খামার, ছাদবাগান ও গ্রিনহাউসে মাটির বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি প্রধানত পানি শুষে নেওয়ার কাজ করে।

মোস্তাফিজ আহমেদ বললেন, ‘ছোবড়ার গুঁড়া দিয়ে আমরা কয়ার পিট ব্লক তৈরির চিন্তাভাবনা করলাম। কারণ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই কয়ার পিটের ব্যাপক চাহিদা। তখন ইউএসএআইডির সহযোগিতায় ভারত থেকে যন্ত্রপাতি এনে ২০১৮ সাল থেকে কয়ার পিট ব্লক উৎপাদন এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় রপ্তানি শুরু করি। বাংলাদেশ থেকে আমরাই প্রথম এ পিট ব্লক রপ্তানি শুরু করি।’

করোনার ধাক্কা

২০২০ সালে করোনার ধাক্কায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় তাঁদের কারখানা। এর আগে ২০১৯ সালে তিনি শুরু করেন নতুন উদ্যোগ। মোস্তাফিজ আহমেদ বলেন, ‘ছোবড়ার পণ্য উৎপাদন করতে গিয়ে দেখলাম দেশে নারকেলের তেল তৈরির আধুনিক কোনো কারখানা নেই। সবাই সনাতন পদ্ধতিতে তেল উৎপাদন করে। তাই চিন্তা করলাম তেল তৈরির আধুনিক একটি কারখানা করব। সেখানে ভার্জিন কোকোনাট অয়েল তৈরি করব। এর মাঝেই করোনা শুরু হয়। ফলে ওই কারখানা আর চালু করা সম্ভব হয়নি।

‘করোনার পর আবার ব্যবসা শুরু করতে গিয়ে দেখলাম জাহাজ ভাড়া অনেক বেড়ে গেছে। ফলে নতুন করে আর কোনো ক্রেতা ধরতে পারিনি। ফলে সব মিলিয়ে দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়ি।’

মোস্তাফিজের ছোট ভাই মোজাহিদ আহমেদ বলেন, ‘প্রায় দুই বছর ধরে আমাদের দুটি কারখানাই বন্ধ ছিল। তখন আমরা চেষ্টা করলাম নতুন পণ্য নিয়ে বাজারে আসার। এ জন্য বিভিন্ন ওয়েবসাইটে আমাদের নানা পণ্যের বিজ্ঞাপন দিই। ওই বিজ্ঞাপন দেখে একদিন গ্রিসের ক্রেতা, “কোকো-মাট” যোগাযোগ করে। তারা আমাদের কাছে নতুন ধরনের পণ্য, ডিসপোজিবল হোটেল স্লিপারের চাহিদা দেয়। পরে আমরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী “নমুনা পণ্য” তৈরি করে পাঠাই। তারা সেটি পছন্দ করে এবং ৯০ হাজার জোড়া ডিসপোজিবল হোটেল স্লিপারের ক্রয়াদেশ দেয়।’

মোস্তাফিজ আহমেদ বলেন, ‘কোকো-মাট আমাদের কিছু টাকাও অগ্রিম দেয়। তা দিয়ে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে পণ্যের উৎপাদন শুরু করি। নারকেলের ছোবড়ার আঁশ দিয়ে তৈরি কয়ার ফেল্ট বা শিট দিয়ে মূলত এ স্লিপার তৈরি হয়।’

কারখানাটির এক পাশে কয়ার ফেল্ট তৈরির ইউনিটে চলে হোটেল ‘স্লিপার’ তৈরির কাজ। গ্রিস থেকে কোকো-মাটের প্রতিনিধিরা এসে ঘুরে দেখছেন কারখানাটি। ওই প্রতিনিধিদলের প্রধান এবং কোকো-মাটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পল এমোফেডিস (Paul Efmorfidis) প্রথম আলোকে বলেন, ‘তারা আমাদের জন্য কোকো স্লিপার তৈরি করছে। মোস্তাফিজ আমাকে সাহসী করে তুলেছে নতুন পণ্য তৈরির বিষয়ে। আমি একটি কাঠের সাইকেল নিয়ে এসেছিলাম, তারা কোনো যন্ত্র ছাড়াই একদিনে আমাকে অবিকল একটি সাইকেল তৈরি করে দেখিয়েছে। আমরা চাই নতুন প্রজন্ম প্লাস্টিকের স্পর্শে না আসুক। সে জন্য আমরা শিশুদের খেলনা থেকে শুরু করে আরও অনেক পণ্য নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে চাই। বাংলাদেশে তৈরি পরিবেশবান্ধব পণ্য আমরা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চাই।’

মোস্তাফিজ আহমেদ বলেন, নারকেলের ছোবড়ার তৈরি পণ্যের পাশাপাশি কাঠের তৈরি বাচ্চাদের ব্যালান্সড সাইকেল, পোষা প্রাণী যেমন কুকুর–বিড়ালের বিছানা, ব্রাশ, খেলনাসহ বেশ কিছু পণ্যের ক্রয়াদেশ দিয়েছে কোকো-মাট। পল বাংলাদেশে আসার সময় কাঠের একটি ছোট সাইকেল নিয়ে এসেছিল। আমরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী কাঠের একটি সাইকেল তৈরি করে দিলে তারা তা পছন্দ করে। এরপর প্রথম চালানেই তারা ২০ হাজার সাইকেলের ক্রয়াদেশ দেয়। এখন আশা করছি কারখানাটি আবারও আগের মতো চালু হবে। তাতে নতুন করে আরও কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হবে।’

মোস্তাফিজ আহমেদ বলেন, সারা বিশ্বেই এখন পরিবেশসম্মত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। উন্নত বিশ্ব এখন আর প্লাস্টিকের ব্যবহার করতে চায় না। নতুন করে বিদেশি ক্রেতারা একবার ব্যবহৃত ব্যাগ, খেলনা ও রান্নাঘরের কিছু পণ্য নিতে আগ্রহী। তবে এ ধরনের পণ্য রপ্তানিতে সরকারি নীতির ক্ষেত্রে কিছু বাধা রয়েছে বলে তিনি জানান। নারকেলের ছোবড়া, কাঠের কোনো পণ্য রপ্তানিতে ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট বা সনদ লাগে। কিন্তু এ সনদ পেতে সমস্যা পোহাতে হয়।

রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বে এ ধরনের পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এসব পণ্যের বৈশ্বিক বাজার প্রায় পুরোটা চীনের দখলে। গত ৩ মার্চ একবার ব্যবহার্য “স্লিপার” রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রথমবার এ ধরনের পণ্যের রপ্তানি শুরু হয়। প্রথম আমরা এ ধরনের পণ্যের বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশ করলাম। আশা করছি, একটা ভালো অবস্থান তৈরি করতে পারব। তাতে বাংলাদেশে এ ধরনের পণ্য তৈরির আরও কারখানা গড়ে উঠবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতি–সহায়তা পেলে রপ্তানিবাজারে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার কথা জানান মোস্তাফিজ আহমেদ।

‘ডাব’ না পাড়লে কী হয়? উত্তরটা সহজ, ‘নারকেল’। যা দিয়ে পিঠাপুলি তৈরি, তেল উৎপাদনসহ আছে নানা ব্যবহার। তবে নারকেলের বাইরের অংশ ছোবড়া বেশির ভাগ সময় হয় ফেলে দেওয়া হতো, নয়তো জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতেন কেউ কেউ। নারকেলের সেই ছোবড়া দিয়ে এখন তৈরি হচ্ছে কয়ার ফেল্ট, কোকো পিট, একবার ব্যবহার্য হোটেল স্লিপারের (একধরনের পাদুকা) মতো পণ্য। নারকেলের ছোবড়ার আঁশ ও গুঁড়া দিয়ে তৈরি এসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে, আসছে বৈদেশিক মুদ্রা।

যন্ত্রে তৈরি তোশকের (ম্যাট্রেস) ভেতরের অংশ বা কয়ার ফেল্ট দিয়ে নারকেলের ছোবড়ার বিদেশযাত্রার যে ‍সূচনা হয়েছিল, এক দশকের মধ্যে সেই তালিকায় যুক্ত হয় ‘কোকো পিট’। এবার নারকেলের ছোবড়া দিয়ে তৈরি একবার ব্যবহৃত হোটেল স্লিপার রপ্তানি শুরু হয়েছে। পাশাপাশি বাচ্চাদের জন্য কাঠের তৈরি সাইকেল, পোষা প্রাণীর খেলনাসহ নারকেলের ছোবড়ার তৈরি আরও বেশ কিছু নতুন ধরনের পণ্যের ক্রয়াদেশ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। যদিও এখনো এসব পণ্যের রপ্তানি শুরু হয়নি।  

প্রায় দুই দশক ধরে নারকেলের ছোবড়া দিয়ে উদ্ভাবনী পণ্য তৈরির কাজটি করছে ন্যাচারাল ফাইবার নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বাগেরহাটের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) শিল্পনগরীতে দুই সহোদর মোস্তাফিজ আহমেদ (৫৬) ও মোজাহিদ আহমেদ (৫৩) গড়ে তুলেছেন এই কারখানা। কারখানাটি বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো স্লিপার রপ্তানি করেছে গ্রিসে। বিশ্বের বিভিন্ন তারকা মানের হোটেলে এ ধরনের স্লিপার এখন হামেশা দেখা যায়।

শুরুর কথা

১৯৮৪ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ব্যবসা শুরু করেন মোস্তাফিজ আহমেদ। প্রথম জীবনে নারকেল তেলের কারখানা ছিল তাঁর। এই কারখানার জন্য বাগেরহাট ছাড়াও আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে আনা হতো প্রচুর নারকেল। শুকনো মৌসুমে ছোবড়া তখন জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তবে বর্ষায় এ ছোবড়া ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। তাই ফেলনা ছোবড়া কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তার কৌশল খুঁজতে থাকেন মোস্তাফিজ আহমেদ। এমন সময় দাম পড়ে যাওয়ায় হঠাৎ করেই তেলের ব্যবসায় ভাটা পড়ে। কী করা যায়, ভাবতে ভাবতে মনস্থির করলেন, নারকেলের ছোবড়া দিয়ে কিছু তৈরি করবেন। তখন পর্যন্ত তাঁর ভাবনায় ছিল ম্যাট্রেসের ভেতরের অংশ ‘কয়ার ফেল্ট’ তৈরি করা। দেশের বাজারের পাশাপাশি শুরু থেকেই রপ্তানি ছিল তাঁর লক্ষ্য। ২০০৫ সালে উৎপাদনের যায় তার কয়াল ফেল্ট তৈরির কারখানা। অপ্রচলিত এই পণ্য রপ্তানির পেছনে আছে দীর্ঘ গল্প। বাগেরহাট বিসিকে নিজের কারখানায় বসে তাই শোনালেন ন্যাচারাল ফাইবারের স্বত্বাধিকারী মোস্তাফিজ আহমেদ।

ছোবড়া থেকে তোশক

নারকেলের ছোবড়া দিয়ে পণ্য তৈরিতে ভারত বরাবরই সিদ্ধহস্ত। তাই ভারতের হরিয়ানা, দিল্লি, কেরালা, তামিলনাড়ু ও ওডিশা চষে বেড়ালেন মোস্তাফিজ আহমেদ। সেখানকার কারখানায় ছোবড়া দিয়ে কয়ার ফেল্ট তৈরির কৌশল দেখলেন। যন্ত্রপাতি কিনতে গিয়ে দেখেন দাম নাগালের বাইরে। শেষে পশ্চিমবঙ্গের এক কারখানার সঙ্গে চুক্তি হয়। সেই কারখানা থেকে কয়ার ফেল্ট তৈরি করে নিয়ে আসতে থাকলেন। পরে কয়েকজন শ্রমিককে নিয়ে যান এবং কাজ শিখিয়ে আনেন বাগেরহাটের এই উদ্যোক্তা।

২০০২ সালে দেশে ফিরে স্থানীয় উপকরণ ও কারিগর দিয়ে কয়ার ফেল্টের যন্ত্রপাতি তৈরি করে ফেলেন মোস্তাফিজ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘উৎপাদন শুরু করতে আমাদের প্রায় তিন বছর লেগে যায়। তবে এর আগেই কয়েকটি ম্যাট্রেসের কারখানা আমাদের ক্রয়াদেশ দিয়ে দেয়। পরে সেটি বাড়তেই থাকে।’

ছোবড়ার আঁশের সঙ্গে রেজিন বা তরল রবার মিশিয়ে প্রথমে পাতলা শিট তৈরি করা হয়। পরে ম্যাট্রেস কোম্পানির চাহিদা অনুযায়ী কয়েকটি শিটকে তাপ ও চাপ দিয়ে ১ ইঞ্চি থেকে সাড়ে ৫ ইঞ্চি পুরুত্বের কয়ার ফেল্ট প্রস্তুত করা হয়।

ছোবড়ার পর ছোবড়ার গুঁড়া

ন্যাচারাল ফাইবার প্রতিষ্ঠানটিকে নারকেলের ছোবড়ার আঁশ সরবরাহ দিতে আশপাশে ছোট ছোট বেশ কিছু কারখানা গড়ে ওঠে। কিন্তু পণ্যটির চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকায় এ ছোট কারখানাগুলোর সরবরাহে চাহিদা মিটছিল না। এ কারণে ২০১৭ সালে তাঁরা নিজেরাই বাগেরহাটের সদর উপজেলার কররী গ্রামে ছোবড়া থেকে আঁশ তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। এ কারখানা করতে গিয়ে নতুন পরিকল্পনা পেয়ে বসে মোস্তাফিজ আহমেদকে। এক হাজার নারকেলের ছোবড়ায় ৮০ কেজি আঁশ পাওয়া যায়। একই সঙ্গে উপজাত হিসেবে পাওয়া যায় ১৬০ কেজির মতো গুঁড়া।

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউএসএআইডির অ্যাগ্রিকালচার ভ্যালু চেইন (এভিসি) প্রজেক্টের আওতায় জার্মানের ফ্রাঙ্কফুর্ট ফেয়ারে অংশ নেন মোস্তাফিজ। সেখানে তিনি গিয়েছিলেন মূলত কয়ার ফেল্টের ক্রেতা খুঁজতে। সেখানেই প্রথম বিশ্ববাজারে ‘কয়ার পিটের’ চাহিদার বিষয়ে জানতে পারেন তিনি। কয়ার পিট ব্যবহৃত হয় সাধারণত গবাদিপশুর খামার, ছাদবাগান ও গ্রিনহাউসে মাটির বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি প্রধানত পানি শুষে নেওয়ার কাজ করে।

মোস্তাফিজ আহমেদ বললেন, ‘ছোবড়ার গুঁড়া দিয়ে আমরা কয়ার পিট ব্লক তৈরির চিন্তাভাবনা করলাম। কারণ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই কয়ার পিটের ব্যাপক চাহিদা। তখন ইউএসএআইডির সহযোগিতায় ভারত থেকে যন্ত্রপাতি এনে ২০১৮ সাল থেকে কয়ার পিট ব্লক উৎপাদন এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় রপ্তানি শুরু করি। বাংলাদেশ থেকে আমরাই প্রথম এ পিট ব্লক রপ্তানি শুরু করি।’

করোনার ধাক্কা

২০২০ সালে করোনার ধাক্কায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় তাঁদের কারখানা। এর আগে ২০১৯ সালে তিনি শুরু করেন নতুন উদ্যোগ। মোস্তাফিজ আহমেদ বলেন, ‘ছোবড়ার পণ্য উৎপাদন করতে গিয়ে দেখলাম দেশে নারকেলের তেল তৈরির আধুনিক কোনো কারখানা নেই। সবাই সনাতন পদ্ধতিতে তেল উৎপাদন করে। তাই চিন্তা করলাম তেল তৈরির আধুনিক একটি কারখানা করব। সেখানে ভার্জিন কোকোনাট অয়েল তৈরি করব। এর মাঝেই করোনা শুরু হয়। ফলে ওই কারখানা আর চালু করা সম্ভব হয়নি।

‘করোনার পর আবার ব্যবসা শুরু করতে গিয়ে দেখলাম জাহাজ ভাড়া অনেক বেড়ে গেছে। ফলে নতুন করে আর কোনো ক্রেতা ধরতে পারিনি। ফলে সব মিলিয়ে দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়ি।’

মোস্তাফিজের ছোট ভাই মোজাহিদ আহমেদ বলেন, ‘প্রায় দুই বছর ধরে আমাদের দুটি কারখানাই বন্ধ ছিল। তখন আমরা চেষ্টা করলাম নতুন পণ্য নিয়ে বাজারে আসার। এ জন্য বিভিন্ন ওয়েবসাইটে আমাদের নানা পণ্যের বিজ্ঞাপন দিই। ওই বিজ্ঞাপন দেখে একদিন গ্রিসের ক্রেতা, “কোকো-মাট” যোগাযোগ করে। তারা আমাদের কাছে নতুন ধরনের পণ্য, ডিসপোজিবল হোটেল স্লিপারের চাহিদা দেয়। পরে আমরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী “নমুনা পণ্য” তৈরি করে পাঠাই। তারা সেটি পছন্দ করে এবং ৯০ হাজার জোড়া ডিসপোজিবল হোটেল স্লিপারের ক্রয়াদেশ দেয়।’

মোস্তাফিজ আহমেদ বলেন, ‘কোকো-মাট আমাদের কিছু টাকাও অগ্রিম দেয়। তা দিয়ে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে পণ্যের উৎপাদন শুরু করি। নারকেলের ছোবড়ার আঁশ দিয়ে তৈরি কয়ার ফেল্ট বা শিট দিয়ে মূলত এ স্লিপার তৈরি হয়।’

কারখানাটির এক পাশে কয়ার ফেল্ট তৈরির ইউনিটে চলে হোটেল ‘স্লিপার’ তৈরির কাজ। গ্রিস থেকে কোকো-মাটের প্রতিনিধিরা এসে ঘুরে দেখছেন কারখানাটি। ওই প্রতিনিধিদলের প্রধান এবং কোকো-মাটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পল এমোফেডিস (Paul Efmorfidis) প্রথম আলোকে বলেন, ‘তারা আমাদের জন্য কোকো স্লিপার তৈরি করছে। মোস্তাফিজ আমাকে সাহসী করে তুলেছে নতুন পণ্য তৈরির বিষয়ে। আমি একটি কাঠের সাইকেল নিয়ে এসেছিলাম, তারা কোনো যন্ত্র ছাড়াই একদিনে আমাকে অবিকল একটি সাইকেল তৈরি করে দেখিয়েছে। আমরা চাই নতুন প্রজন্ম প্লাস্টিকের স্পর্শে না আসুক। সে জন্য আমরা শিশুদের খেলনা থেকে শুরু করে আরও অনেক পণ্য নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে চাই। বাংলাদেশে তৈরি পরিবেশবান্ধব পণ্য আমরা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চাই।’

মোস্তাফিজ আহমেদ বলেন, নারকেলের ছোবড়ার তৈরি পণ্যের পাশাপাশি কাঠের তৈরি বাচ্চাদের ব্যালান্সড সাইকেল, পোষা প্রাণী যেমন কুকুর–বিড়ালের বিছানা, ব্রাশ, খেলনাসহ বেশ কিছু পণ্যের ক্রয়াদেশ দিয়েছে কোকো-মাট। পল বাংলাদেশে আসার সময় কাঠের একটি ছোট সাইকেল নিয়ে এসেছিল। আমরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী কাঠের একটি সাইকেল তৈরি করে দিলে তারা তা পছন্দ করে। এরপর প্রথম চালানেই তারা ২০ হাজার সাইকেলের ক্রয়াদেশ দেয়। এখন আশা করছি কারখানাটি আবারও আগের মতো চালু হবে। তাতে নতুন করে আরও কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হবে।’

মোস্তাফিজ আহমেদ বলেন, সারা বিশ্বেই এখন পরিবেশসম্মত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। উন্নত বিশ্ব এখন আর প্লাস্টিকের ব্যবহার করতে চায় না। নতুন করে বিদেশি ক্রেতারা একবার ব্যবহৃত ব্যাগ, খেলনা ও রান্নাঘরের কিছু পণ্য নিতে আগ্রহী। তবে এ ধরনের পণ্য রপ্তানিতে সরকারি নীতির ক্ষেত্রে কিছু বাধা রয়েছে বলে তিনি জানান। নারকেলের ছোবড়া, কাঠের কোনো পণ্য রপ্তানিতে ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট বা সনদ লাগে। কিন্তু এ সনদ পেতে সমস্যা পোহাতে হয়।

রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বে এ ধরনের পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এসব পণ্যের বৈশ্বিক বাজার প্রায় পুরোটা চীনের দখলে। গত ৩ মার্চ একবার ব্যবহার্য “স্লিপার” রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রথমবার এ ধরনের পণ্যের রপ্তানি শুরু হয়। প্রথম আমরা এ ধরনের পণ্যের বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশ করলাম। আশা করছি, একটা ভালো অবস্থান তৈরি করতে পারব। তাতে বাংলাদেশে এ ধরনের পণ্য তৈরির আরও কারখানা গড়ে উঠবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতি–সহায়তা পেলে রপ্তানিবাজারে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার কথা জানান মোস্তাফিজ আহমেদ।

লেখক থেকে আরো

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

Advertismentspot_img

সাম্প্রতিক সংবাদ

আরও কত বছর চাপে থাকবে বাংলাদেশের অর্থনীতি?

বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও এক বছর চাপে থাকবে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন জিডিপি কমে ৪ শতাংশ হবে। তবে...

ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমছে কেন?

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমছে। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, টাকার মান কমে যাওয়ার পেছেনে বেশ কিছু...

প্যারিসে গাড়ির প্রদর্শনীতে চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ির আধিপত্য

চীনা পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে বরাবরই শুল্ক আরোপের চর্চা অব্যাহত রেখেছে পশ্চিমা বিশ্ব। এই ধারাবাহিকতায় চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানিতে আগামী পাঁচ বছরে শুল্ক ১০...

সর্বশেষ খবরের সাথে আপ টু ডেট থাকতে চান?

আমরা আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই! আপনার বিবরণ পূরণ করুন এবং আমরা আমাদের সকল আপডেট আপনাকে জানাবো।