২০১৪ সালে ছোটভাবে শুরু হওয়া এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা এখন বেশ বড় আকার ধারণ করেছে। এজেন্টদের মাধ্যমে দেশের আনাচকানাচে পৌঁছে গেছে ব্যাংকিং সেবা। দেশজুড়ে ২১ হাজার কেন্দ্রের মাধ্যমে দেওয়া এই সেবা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এজেন্টদের মাধ্যমে টাকা জমা দেওয়া, ঋণ নেওয়া, পরিষেবা বিল পরিশোধ, প্রবাসী আয় গ্রহণসহ নানা ধরনের সেবা মিলছে। সব মিলিয়ে এজেন্ট ব্যাংকিং চালু হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যসহ গ্রামীণ অর্থনীতি বেশ চাঙা হচ্ছে। কারণ, এজেন্টদের ৮৫ শতাংশই গ্রাম এলাকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত এক দশকে বিভিন্ন ব্যাংকের এজেন্টরা দুই কোটির বেশি গ্রাহক পেয়েছেন। এসব এজেন্ট আমানত পেয়েছেন ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি, আর এ সময়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে।
গ্রাম এলাকার আমানত সংগ্রহ পেতে কিছু ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং সেবাকে বেছে নিয়েছে। কোনো কোনো ব্যাংক গ্রাম থেকে আমানত সংগ্রহ করে করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে। তবে উল্টো পথেও হাঁটছে কোনো কোনো ব্যাংক। যেমন ব্র্যাক ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় যে আমানত পেয়েছে, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তার সাত গুণের বেশি ঋণ দিয়েছে। একই ভাবে সিটি ব্যাংক এজেন্টদের মাধ্যমে যে আমানত সংগ্রহ করেছে, তাদের মাধ্যমে তার তিন গুণের বেশি ঋণ দিয়েছে। এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় ব্র্যাক ব্যাংকের আমানত ১ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা, আর ঋণ ৮ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। এই সেবায় সিটি ব্যাংকের আমানত ৫১২ কোটি টাকা, ঋণ ১ হাজার ৯১০ কোটি। এর মাধ্যমে ব্যাংক দুটি প্রগতিশীল ব্যাংকিং চর্চা করছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
বিশ্বের প্রথম এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালু হয়েছিল ব্রাজিলে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা–সংক্রান্ত নীতিমালা জারি করে। সেই নীতিমালা অনুযায়ী, এজেন্ট ব্যাংকিং পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিটি এজেন্টের একটি চলতি হিসাব থাকতে হয়। এ সেবার মাধ্যমে অর্থ জমা ও উত্তোলন করা যায়। পাশাপাশি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স স্থানীয় মুদ্রায় বিতরণ, ছোট অঙ্কের ঋণ প্রদান ও আদায় এবং এককালীন জমার কাজও করেন এজেন্টরা। তাঁদের মাধ্যমে বিভিন্ন পরিষেবার বিল পরিশোধের পাশাপাশি সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর অর্থও উত্তোলন করা যায়।
এ ছাড়া নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংক হিসাব খোলা, ঋণ আবেদন, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের নথিপত্র সংগ্রহ করতে পারেন এসব এজেন্ট। তবে এখনো বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের কোনো সুযোগ নেই এজেন্টদের। করোনাভাইরাসের প্রকোপের সময় এই সেবার প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়। ২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিলে ব্যাংকের শাখা বন্ধ থাকলেও সে সময় সব এজেন্ট খোলা ছিল। এতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ওপর মানুষের আস্থা আরও বৃদ্ধি পায়। ফলে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় ভালো প্রবৃদ্ধি হয়।
ব্যাংকের শাখার মতো শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) সুপরিসর ও ছিমছাম কক্ষ ব্যবহার না করে এজেন্টরা নিজেদের ছোট দোকানঘরে এই সেবা দিচ্ছে। তবে তারা এখন ব্যাংকের প্রায় সব ধরনের সেবাই দিচ্ছে। ফলে সব শ্রেণি–পেশার মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে এই কার্যক্রম।
যাত্রা শুরুর ১০ বছরে এই সেবা কার্যক্রমের বড় অর্জন হলো দুই কোটির বেশি গ্রাহক তৈরি করা। গত সেপ্টেম্বর শেষে এই সেবার গ্রাহক বেড়ে হয়েছে ২ কোটি ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৫৩৭ জন। এর চেয়ে বড় সাফল্য হলো, গ্রাহকদের প্রায় অর্ধেকই নারী। গত সেপ্টেম্বরে নারীদের হিসাব ছিল ১ কোটি ২ লাখ ৮৭ হাজার ৮৮১টি। আবার গ্রাহকদের সিংহভাগই গ্রাম এলাকার। সেপ্টেম্বরে গ্রামাঞ্চলের হিসাব ছিল ১ কোটি ৭৮ লাখ ১৮ হাজার ৯৬৬টি। এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় সেবা ছড়িয়ে পড়েছে। এর আগে ব্যাংকগুলো তাদের সব শাখার মাধ্যমেও গ্রামে এত গ্রাহক তৈরি করতে পারেনি।
এসব গ্রাহক শুধু হিসাব খুলেছেন বিষয়টি তেমন না। এসব গ্রাহক এজেন্টদের কাছে বিভিন্ন ধরনের আমানত হিসাব খুলেছেন। এসব হিসাবে জমা হয়েছে ৩৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। আর এজেন্টদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ হয়েছে ১৪ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের তুলনায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে আমানতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ, তবে ঋণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে অনেক বেশি, ৮৯ দশমিক ৮১ শতাংশ।
ব্যাংকগুলো এখন এজেন্টদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণকে আগের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। এতে চাঙা হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি। পাশাপাশি এই সেবার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্রবাসী আয় বিতরণ হচ্ছে। প্রবাসী আয়ের এক–তৃতীয়াংশ অর্থ ব্যাংকে জমা রাখেন গ্রাহকেরা, যা এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার আমানত বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। ব্যাংকগুলো এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা ইউনিয়ন সেন্টারে নিয়ে গেছে। ব্যাংকিং কার্যক্রমের পাশাপাশি গ্রামগঞ্জে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভাতা বিতরণে ভূমিকা রাখছেন এজেন্টরা।
ব্যাংকাররা বলেন, কেউ বাসার পাশে সেবা পাওয়ার জন্য, আবার কেউবা সঞ্চয়ের জন্য এজেন্ট ব্যাংকিং হিসাব খুলেছেন। করোনাকালে এজেন্ট ব্যাংক সেবা দিয়েছে। এ কারণে এই সেবার প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে। ফলে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে আমানত রাখার পাশাপাশি এর মাধ্যমে ঋণ বিতরণ ও প্রবাসী আয় তথা রেমিট্যান্স আনার পরিমাণও বেড়েছে।
স্বল্প সময়ে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় প্রবৃদ্ধির কথা বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এই সেবা বিকাশের অন্যতম কারণ হলো, এটি আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ও ব্যয়সাশ্রয়ী। এজেন্ট আউটলেটে একজন গ্রাহক সহজেই তাঁর বায়োমেট্রিক বা হাতের আঙুলের ছাপের মাধ্যমে হিসাব পরিচালনা করতে পারেন। তাই গ্রামীণ জনপদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যকর একটি উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ জন্য ব্যাংকগুলোও তাদের এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম প্রতিনিয়ত বাড়াচ্ছে।