গত ২৬ শে আগস্ট ভারতের ইকোনমিক টাইমসের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ২০২৩- ২৪ অর্থবছরে ভারত-বাংলাদেশে যে পরিমাণ অন্য রপ্তানি করেছে । বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি যেমন জাপান জার্মানি বা ফ্রান্সেও সে পরিমাণ রপ্তানি করেন।
শুধু তাই নয় ভারত-বাংলাদেশের বিপক্ষীয় বাণিজ্যে যে হারে বেড়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য সেই এই অনুপাতে বাড়েনি। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে ভারতের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ২.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ২০২৩ সালে যা ১৩.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নত হয় ।
অর্থাৎ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বেড়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ। তবে এর মধ্যে বাংলাদেশ ভারতের রপ্তানি আর বেড়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ।২০০৯ সালে ভারতের পন্য বাণিজ্যে ১.২ শতাংশের গন্তব্য ছিল বাংলাদেশ ।
আর ২০২৩ সালে তা দ্বারায় ২৬ শতাংশ ।বর্তমানে ভারতের পঞ্চম বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য হচ্ছে বাংলাদেশ । অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন ভারতের অন্যতম বৃহত্তম অংশীদার এবং দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম ।বাংলাদেশের যেসব দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করা হয় সেই তালিকায় এখন চীনের পরই রয়েছে ভারত ।
তবে দুই দেশের বাণিজ্য ভারসাম্য হেলে আছে ভারতের দিকেই । ভারত থেকে যত মূল্যের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ রপ্তানি করে মাত্র তার সাত ভাগের এক অংশ ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি বিল পরিশোধের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১১-১২ অর্থবছর ভারত থেকে ৭.৭৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল বাংলাদেশ । এর পরের দশক জুড়ে আমদানি কেবল বেড়েই চলছে ।
২০২১-২২ অর্থবছরে এসে ভারত থেকে আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ১, ৩৬৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে । অর্থাৎ গত এক দশকে ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানি বেড়েছে তিন গুণ ।
বাংলাদেশের আমদানি করা ভারতীয় পণ্যের তালিকার শীর্ষে আছে তুলা । ভারতের তুলার জন্য সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে বাংলাদেশ। যা ভারতের বৈশ্বিক তুলার পরিমাণ প্রায় ৩৫ শতাংশ । আর ভারত থেকে বাংলাদেশের মোট আমদানি খরচের প্রায় এক থেকে অংশই হয় তুলা আমদানিতে ।
এরপর আছে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও ভোগ্যপণ্য। ভারতের কৃষি পণ্য রপ্তানির ২০ শতাংশই হয় বাংলাদেশে । আরো রয়েছে রেলের বগি, ইঞ্জিন সহ অন্যান্য আনুষাঙ্গিক যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ ।
অবশ্য গত কয়েক বছরে ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের বাজারে বড় পরিবর্তন এসেছে। পেয়াজ বা কাঁচা মরিচ থেকে শুরু করে খাদ্যপন্ন আমদানির পাশাপাশি । বর্তমানে , কাঁচামাল ও শিল্পায়নের প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রের মত পণ্য আমদানি করার প্রবণতা বেড়েছে।
অর্থাৎ , ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের একটা বড় অংশ রপ্তানি খাতে কাঁচামাল কিংবা যন্ত্রপাতি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে । বর্তমানে বাংলাদেশের পোশাক খাতের প্রয়োজনীয় কাঁচামলের সিংহভাগ আমদানি করা হয় ভারত থেকে ।
মূলত ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই ভারত থেকে আমদানি বেশি হচ্ছে বলে মত ব্যবসায়ীদের ।
ভারত-বাংলাদেশের কাছে হওয়ায়। অন্য দেশে তুলনায় কম সময়ে ভারত থেকে বন্ধ আমদানি করা যায়। সড়ক পথে আনা যায় বলে পরিবহন খরচ কম । ব্যবসায়ীদের মতে, যেসব পণ্য ভারত থেকে আমদানি করা হয়। সেগুলো অন্য দেশ থেকে আনতে গেলে খরচ ২০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়ে যাবে।
এই কারণে পেঁয়াজ মরিচ বা চালের মতো পন্য এবং শিল্পের কাঁচামাল , অন্য দেশ থেকে আনা গেলেও । আমদানি কারকদের প্রথম পছন্দ ভারত।
অন্যদিকে রপ্তানি উন্নয়ন গরু ইপিবির তথ্য অনুযায়ী । ভারত থেকে আমদানির বিপরীতে রপ্তানি পরিমাণ অনেক কম । তবে গত কয়েক বছর ধরে রপ্তানির পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ভারতে ৮৭ কোটি ডলারের পণ্য সেবা রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। সে হিসেবে বাংলাদেশী পণ্য ও সেবা রপ্তানি গন্তব্যের তালিকায় ভারতের স্থান ছিল দ্বাদশ।
পাঁচ বছরের মধ্যে ভারতের অবস্থান এখন সপ্তম। ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারতে ১৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। আর গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ২০০ কোটি বা দুই বিলিয়ন ডালার ছাড়িয়ে যায় ।
ওই অর্থবছরে ভারতে ২১৩ কোটি বা ২.১৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্যের রপ্তানি হয় । যা ছিল আগের অর্থবছরের থেকে ৭ শতাংশ বেশি । ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় , ভারতের বাজারে রপ্তানি হওয়া শীর্ষস্থানীয় বাংলাদেশি পণ্যগুলো হচ্ছে । তৈরি পোশাক, পাট ও পাটের সুতা, হোম টেক্সটাইল, সয়াবিন তেল , হিমায়িত মাছ , প্লাস্টিক ইত্যাদি ।
ভারতের রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশী পণ্যের প্রায় ৫০ শতাংশই তৈরি পোশাক ।
২০২০- ২১ অর্থবছরে ভারতে ৪২ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ । পরের অর্থবছরের সেটি বেড়ে ৭১ কোটি ডলারে দাঁড়ায় । আর গত
২২-২৩ অর্থবছরে ভারতে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় ১০১ কোটি ডলারের । অর্থাৎ দুই বছরের ব্যবধানে ভারতের তৈরি পোশাক রপ্তানি দ্বিগুণের বেশি বেড়েছিল । ফলে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারতের বাজারকে যথেষ্ট সম্ভাবনাময় হিসেবে দেখা হচ্ছিল ।
এদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে ১১ই জুলাই থেকে । ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য শুরু হয় । আশা করা হচ্ছিল রুপি দিয়ে বাণিজ্য শুরু হলে ভারতের রপ্তানি পরিমাণ আরো বাড়বে । কিন্তু উল্টো রপ্তানিতে ঘটে ছন্দ পতন । ২০২৩/২৪ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ভারতে বাংলাদেশী পণ্যের পরিমাণ কমেছে প্রায় ১৭ শতাংশ ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে অর্থাৎ , জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি সময়ে ভারতের বাজারে ১.২৭ বিলিয়ন ডলারের বন্ধ রপ্তানি হয় । এর আগের অর্থ বছরের রপ্তানি হয়েছিল ১২৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য । অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভারতের বাজারে রপ্তানি কমার ক্ষেত্রে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে, তৈরি পোশাকের রপ্তানির ২৩ শতাংশ কমে যাওয়া ।
ইপিবির হিসেবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে । মোট ৫৮ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করা হয়েছে ভারতে । যা গত অর্থ বছরের একই সময় ছিল ৭৫ কোটি ডলার । এই হিসেবে রপ্তানি কমেছে ২,২৯৯ শতাংশ ।
অবশ্য এর আগেও ২০১১ সালে । বাংলাদেশের বেশ কিছু কারখানার কাছ থেকে । ভারতীয় কোম্পানি পোশাক নিয়ে অর্থ পরিষদ না করায় । কয়েক বছর পোশাক রপ্তানিতে ভাটা পড়েছিল । পরবর্তীতে ভারতের বিভিন্ন শহরে , আন্তর্জাতিক ব্রান্ডগুলো বিক্রয় কেন্দ্র খোলায় । পোশাক রপ্তানি ও বৃদ্ধি পাচ্ছিল ।
তবে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সামরিকভাবে ভারতের আমদানি কম হয় । বাংলাদেশের পোশাকরপ্তানিতেও এর প্রভাব পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা । তৈরি পোশাক ছাড়াও , ভারতের পাট ও পাট সুতার রপ্তানি কমেছে, এক শতাংশের মতো ।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের , প্রথম আট মাসে ১৩ কোটি ৭৬ লাখ ডলার এর পাট ও পাট সুতা রপ্তানি হয়েছে । যা এর আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার । এছাড়াও হোম টেক্সটাইল পন্নের রপ্তানিও কমেছে সাড়ে ৬ শতাংশ ।
তবে এই সময়ে ভারতে চামড়া জাত পণ্য ও জুতা রপ্তানি কিছুটা বেড়েছে । জানা যায় ২০১১ সালে বাংলাদেশকে অস্ত্র ,মাদক বাদে । সব পন্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছিল ভারত । এরপরও ভারতের রপ্তানি বাজার বড় করতে পারছিলনা বাংলাদেশ । এক ব্যতিক্রম ছিল পোশাক খাত ।
এই খাতে ভারতের বিশাল বাজারকে ধরার যে একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল । সেখানেও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা । খুব সাম্প্রতিক বাংলাদেশের রাজনৈতিক পদ পরিবর্তন এবং শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর । ভারতের অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বা পড়তে যাচ্ছে তা নিয়ে উদ্বেগ দেখিয়েছে ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যম ।
ইকোনমিক টাইমসের প্রতিদানে বলা হয়েছে , ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানি কমলে সবচেয়ে বেশি মার খাবে তুলা ও সুতা । এতে তুলা উৎপাদন এবং সরবরাহে জড়িত ভারতের কৃষকরা, বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে সংবাদের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে । কিন্তু একই সাথে ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে সুতার দাম কমতে পারে । এর ফলে ভারতে তৈরি পোশাক খাতের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হতে পারে ।
বাংলাদেশ বিশ্ব বাজারে ভারতের অন্যতম বড় প্রতিযোগী । তাই বাংলাদেশে তুলা সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে । বিশ্ব বাজারে , ভারতীয় পোশাকের পণ্য চাহিদা বাড়তে পারে । বাংলাদেশের চলমান আর্থ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে । অর্থনীতি আরো আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে । ভারত থেকে বাংলাদেশের পণ্য আমদানির চাহিদাও কমতে পারে । এতে বাংলাদেশের রপ্তানী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে । তবে সক্ষমতার অভাবে, ভারতের ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগ নিতে পারবে না বলে মত প্রকাশ করেছে অনেকে।