হাসিনা-আদানির গোপন সেই বিদ্যুৎ চুক্তিতে কী ছিল…?

ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার বিষয়ে শেখ হাসিনার যে চুক্তিটি হয়েছিল, সেই চুক্তির শর্তগুলো ছিল সম্পূর্ণ গোপনীয়। বাংলাদেশের চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকার পরও, ঠিক কি কারণে শেখ হাসিনা ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করার এই গোপন চুক্তিটি করেছিল তা কারো কাছেই বোধগম্য নয়।
হাসিনার সাথে করা আদানির সেই গোপন চুক্তি ছিল কর্পোরেট জালিয়াতির সর্বোচ্চ উদাহরণ। চুক্তির শর্তগুলো সবার সামনে আসলে, দেশে এই বিষয়টি নিয়ে মারাত্মক অসন্তোষ তৈরি হতে পারতো, সে কারণেই আওয়ামী লীগ সরকার আদানির সাথে করা চুক্তির শর্তগুলো গোপন করেছিল।
সেই গোপন যুক্তির খেসারও দিতে হচ্ছে বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারকে। আদানি পাওয়ার বাংলাদেশের কাছে তাদের ৮০০ মিলিয়ন ডলার বা ৯,০৫৬৩ কোটি টাকা বকেয়া পাওনা পরিশোধ করার জন্য। প্রধান উপদেষ্টা ডঃ মুহাম্মদ এর কাছে চিঠি লিখে তাগাদা দিয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে আসেন। তখন নরেন্দ্র মোদী ভারতের কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে ব্যবসা করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে বলেছিল। সেই সফরেই মোদী সরকারের সাথে হাসিনা সরকার ভারতের বিদ্যুৎ কেনার জন্য ৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই করে।
এরপর ২০১৭ সালে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং ভারতের আদানি পাওয়ার লিমিটেড ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার একটি গোপন চুক্তি সই করে। চুক্তিটি গোডা বিদ্যুৎ প্রকল্প হিসেবে পরিচিত। এই চুক্তি অনুযায়ী ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের গোডা জেলায় ১৬০০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। সেখানে থেকে ২৫ বছর বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। এর বাইরে চুক্তির আর কোন শর্ত গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়নি।
আদানির বিদ্যুৎ নিয়ে ভারত বাংলাদেশের সরকারি কর্তৃপক্ষ কখনো খোলামেলা আলোচনা করেনি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে আদানি সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি একটি সার্বভৌম সরকারের সঙ্গে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চুক্তি। এর সঙ্গে ভারত সরকারের কোন সম্পর্ক নেই।
অন্যদিকে শেখ হাসিনার জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক ইলাহী ইন্ডিয়া এনার্জি উইকে বলেছে, আদানির সাথে বাংলাদেশের চুক্তিটি গোপনীয়।
গোডা বিদ্যুৎ প্রকল্প চুক্তির গোপনীয়তার কারণে ভারত- বাংলাদেশ কোন দেশের গণমাধ্যমেই এই সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হয়নি। তবে মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াশিং পোস্ট হাসিনা এবং আদানির সেই গোপন চুক্তির ১৬৩ পৃষ্ঠার অতি গোপন নথি সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়।
এরপর ওয়াশিংটন পোস্ট তিনজন জ্বালানি বিশেষজ্ঞকে দিয়ে চুক্তিটি পর্যালোচনা করিয়ে একটি রিপোর্ট রিপোর্ট প্রকাশ করে। ওয়াশিংটন পোষ্টের সেই রিপোর্ট থেকে জানা যায়। গোডা বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে যাওয়ার পর থেকে আদানী পাওয়ার। কোন বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও বাংলাদেশকে প্রতিবছর ৪০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে।
আদানি গ্রুপ এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বাংলাদেশের কাছ থেকে আদায় করবে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ভিত্তিক জ্বালানি বিশ্লেষক টিম বারকলি চুক্তিটি পর্যালোচনা করে জানিয়েছেন। বিদ্যুৎ খাতের বৈশ্বিক মান অনুযায়ী আদানি গ্রুপের ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেশি। তিনি আরো জানান, বাংলাদেশ পাইকারি বিদ্যুতের যে বাজার মূল্য তার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি দামে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনবে বাংলাদেশ। অথচ এই চুক্তি দেখেই আওয়ামী লীগ সরকার দাবি করেছিল। আদানির সাথে চুক্তিটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত লাভজনক।
গোড্ডার বিদ্যুৎ প্রকল্পটি যেহেতু একটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র। তাই আদানি গ্রুপের সাথে যুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল কয়লার দাম নির্ধারণ। বাংলাদেশ সরকার দেশের কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে কয়লার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করে। আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম বেড়ে গেলেও সরকার নির্দিষ্ট অর্থের বেশি টাকা প্রদান করে না।
কিন্তু আদানির সাথে চুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে। গোডা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লার দাম আন্তর্জাতিক বাজার দর অনুযায়ী পরিশোধ করার চুক্তি করেছিল। যদিও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে কয়লার দাম প্রায় তিন গুন বেড়েছে। তারপরও কয়লা সরবরাহে খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না। কারণ ভারতের ৩৬গড়, ঝাড়খন্ড এবং উড়িষ্যা রাজ্যে আধুনিক রুপের বিশাল বিশাল কয়লার খনি আছে। এমনকি ভারতে কয়লা উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া ছয়টি খনির মধ্যে ৪টি খনির ঠিকাদারি পেয়েছে আদানির কোম্পানি।
শুধু তাই নয় অস্ট্রেলিয়ার কোইন্সল্যান্ডে থাকা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কয়লা খনি ও আদানি গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আদানি গ্রুপের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে তারা বছরে 9 কোটি টন কয়লা উৎপাদন করতে পারে। এবং আগামী ৩০ বছরে তারা ৩০০ কোটি টন কয়লা মজুদ করার সক্ষমতা রাখে। গ্লোবাল এনার্জি মনিটরের তথ্য মতে গৌতম আদানীর কোম্পানি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে ব্যক্তিগত কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং কয়লা খনির মালিক।
ভারতে এত কয়লার মালিকানা থাকার পরও আদানি পাওয়ার চুক্তিতে দেখিয়েছে যে তারা প্রতিবছর ৭০ লক্ষ টন কয়লা বিদেশ থেকে আমদানি করবে। এত বিপুল পরিমাণ কয়লা বিদেশ থেকে আমদানি করলে সভাবতই তার দাম বেশি পড়বে। কিন্তু সেখানেও আদানি গ্রুপই লাভবান হবে। কারণ অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা বিদেশি কয়লার মালিকও আদানি নিজেই। সেই সাথে কয়লা আবার যে বন্দরে খালাস করা হবে সেই সমুদ্রবন্দরও আদানির মালিকানাধীন। পরিবহনের জন্য যে রেললাইন ব্যবহার করা হবে সেই রেললাইনও আদানিরই তৈরি করা।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে আদানি গ্রুপ প্রতি টন কয়লার দাম ধরেছে ৪০০ ডলার। অথচ বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ চীনের যৌথ বিনিয়োগের করা পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লার দাম পরেছে প্রতি টন ২৫০ ডলারের মত। আদানী প্রতিজন কয়লার যে দাম প্রস্তাব করেছিল তার রামপাল ও পায়রার চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি। আদানের কয়লার দাম বেশি হবার কারণে বাংলাদেশ উৎপাদন করলে যে বিদ্যুতের দাম হত ১৩ থেকে ১৪ টাকা আধানীর কাছ থেকে তা ২২ টাকায় কিনতে হচ্ছে। বাংলাদেশ যদি আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ না কিনে, সেক্ষেত্রেও প্রতিবছর আদানিকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। বাংলাদেশী টাকায় যার মূল্য ৪,৭৮১ কোটি টাকা।

তার মানে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনা বাদ দিলেও ২০৪৫ সাল পর্যন্ত, প্রতিবছর প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা আদানিকে দিয়ে যেতে হবে। ডলারের দাম বাড়লে এই টাকা আরো বাড়বে। আগামী ২৫ বছর আদানিকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিলে তার পরিমাণ দাঁড়াবে ১ লক্ষ ২৫ হাজার কোটি টাকারও অনেক বেশি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা ওয়াশিংটন পোস্ট কে বলেছিল বাংলাদেশের সাথে করা আদানির এই চুক্তিটি অবশ্যই প্রতারণা। আর বাংলাদেশের পক্ষে এই চুক্তির বৈধতা দিয়ে দেশের জনগণনের সাথে চূড়ান্ত পর্যায়ের বিশ্বাসঘাতকতার কাজটি করেছে, শেখ হাসিনার জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক ইলাহী। আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হলেও। শেখ হাসিনার মাফিয়া সরকারের লোকজন ব্যক্তিগত ভাবে লাভবান হয়েছে।

শেখ হাসিনার আমলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গিয়ে বাংলাদেশ চরম আর্থিক সংকটে পড়েছিল। সে কারণেই হয়তো দীর্ঘদিন আদানির বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধ করা থেকে বিরত ছিল হাসিনা সরকার। বর্তমানে বাংলাদেশের তীব্র বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে। আদানি পাওয়ারের মোটা অংকের দেনা করার বিষয়টি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বারতি মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শেখ হাসিনা শুধু আদানির কাছ থেকেই নয়। ভারতের বেশ কয়েকটি সরকারি বিদ্যুৎ সংস্থার কাছ থেকেও বিদ্যুৎ আমদানি করেছে। সব মিলিয়ে ভারতের কাছে বাংলাদেশের বকেয়ার পরিমাণ ১০০ কোটি ডলার বা এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশী টাকায় যার মূল্য ১১,৯৫৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু আদানির কাছেই বকেয়া আছে ৮০০ মিলিয়ন ডলার বা ৯ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা।
আদানি পাওয়ার ইতোমধ্যেই প্রধান উপদেষ্টা ডঃ মোঃ ইউনূসের কাছে চিঠি লিখে এই টাকা পরিশোধ করার তাগাদা দিয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের একটি অংশ এখনই পরিশোধ না করলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংকট আরো তীব্র হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ ইতোমধ্যেই আদানি অন্তত ৫০০ মেগাওয়া বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে।
ভারতের আদানি গ্রুপ বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত একটি প্রতারক প্রতিষ্ঠান। ২০২৩ সালে মার্কিন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান হিন্দেন বার্গ রিসার্চ আদানি গ্রুপের কর্পোরেট জালিয়াতি প্রকাশ করার পর। আদানি রাতারাতি ১০০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ হারিয়েছিল। অতীতে কয়লা খনি কেলেঙ্কারির কারণে অস্ট্রেলিয়ার জনগণ আদানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে কেনিয়ায়ও বিমানবন্দর কেলেঙ্কারিতে আদানি গ্রুপ নিন্দিত হয়েছে।
সেই আদানির সাথে হাসিনা সরকার বাংলাদেশের টাকা দিয়ে ভারতের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি দামে বিদ্যুৎ আমদানি করার অন্যাজো চুক্তি করেছিল। বাংলাদেশের জনগণকে না জানিয়ে, গোপনে এমন প্রতারণামূলক চুক্তি সই করা প্রকৃতপক্ষে দেশ বিক্রি করে দেওয়ারই নামান্তর।

ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার বিষয়ে শেখ হাসিনার যে চুক্তিটি হয়েছিল, সেই চুক্তির শর্তগুলো ছিল সম্পূর্ণ গোপনীয়। বাংলাদেশের চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকার পরও, ঠিক কি কারণে শেখ হাসিনা ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করার এই গোপন চুক্তিটি করেছিল তা কারো কাছেই বোধগম্য নয়।
হাসিনার সাথে করা আদানির সেই গোপন চুক্তি ছিল কর্পোরেট জালিয়াতির সর্বোচ্চ উদাহরণ। চুক্তির শর্তগুলো সবার সামনে আসলে, দেশে এই বিষয়টি নিয়ে মারাত্মক অসন্তোষ তৈরি হতে পারতো, সে কারণেই আওয়ামী লীগ সরকার আদানির সাথে করা চুক্তির শর্তগুলো গোপন করেছিল।
সেই গোপন যুক্তির খেসারও দিতে হচ্ছে বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারকে। আদানি পাওয়ার বাংলাদেশের কাছে তাদের ৮০০ মিলিয়ন ডলার বা ৯,০৫৬৩ কোটি টাকা বকেয়া পাওনা পরিশোধ করার জন্য। প্রধান উপদেষ্টা ডঃ মুহাম্মদ এর কাছে চিঠি লিখে তাগাদা দিয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে আসেন। তখন নরেন্দ্র মোদী ভারতের কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে ব্যবসা করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে বলেছিল। সেই সফরেই মোদী সরকারের সাথে হাসিনা সরকার ভারতের বিদ্যুৎ কেনার জন্য ৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই করে।
এরপর ২০১৭ সালে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং ভারতের আদানি পাওয়ার লিমিটেড ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার একটি গোপন চুক্তি সই করে। চুক্তিটি গোডা বিদ্যুৎ প্রকল্প হিসেবে পরিচিত। এই চুক্তি অনুযায়ী ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের গোডা জেলায় ১৬০০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। সেখানে থেকে ২৫ বছর বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। এর বাইরে চুক্তির আর কোন শর্ত গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়নি।
আদানির বিদ্যুৎ নিয়ে ভারত বাংলাদেশের সরকারি কর্তৃপক্ষ কখনো খোলামেলা আলোচনা করেনি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে আদানি সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি একটি সার্বভৌম সরকারের সঙ্গে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চুক্তি। এর সঙ্গে ভারত সরকারের কোন সম্পর্ক নেই।
অন্যদিকে শেখ হাসিনার জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক ইলাহী ইন্ডিয়া এনার্জি উইকে বলেছে, আদানির সাথে বাংলাদেশের চুক্তিটি গোপনীয়।
গোডা বিদ্যুৎ প্রকল্প চুক্তির গোপনীয়তার কারণে ভারত- বাংলাদেশ কোন দেশের গণমাধ্যমেই এই সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হয়নি। তবে মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াশিং পোস্ট হাসিনা এবং আদানির সেই গোপন চুক্তির ১৬৩ পৃষ্ঠার অতি গোপন নথি সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়।
এরপর ওয়াশিংটন পোস্ট তিনজন জ্বালানি বিশেষজ্ঞকে দিয়ে চুক্তিটি পর্যালোচনা করিয়ে একটি রিপোর্ট রিপোর্ট প্রকাশ করে। ওয়াশিংটন পোষ্টের সেই রিপোর্ট থেকে জানা যায়। গোডা বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে যাওয়ার পর থেকে আদানী পাওয়ার। কোন বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও বাংলাদেশকে প্রতিবছর ৪০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে।
আদানি গ্রুপ এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বাংলাদেশের কাছ থেকে আদায় করবে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ভিত্তিক জ্বালানি বিশ্লেষক টিম বারকলি চুক্তিটি পর্যালোচনা করে জানিয়েছেন। বিদ্যুৎ খাতের বৈশ্বিক মান অনুযায়ী আদানি গ্রুপের ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেশি। তিনি আরো জানান, বাংলাদেশ পাইকারি বিদ্যুতের যে বাজার মূল্য তার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি দামে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনবে বাংলাদেশ। অথচ এই চুক্তি দেখেই আওয়ামী লীগ সরকার দাবি করেছিল। আদানির সাথে চুক্তিটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত লাভজনক।
গোড্ডার বিদ্যুৎ প্রকল্পটি যেহেতু একটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র। তাই আদানি গ্রুপের সাথে যুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল কয়লার দাম নির্ধারণ। বাংলাদেশ সরকার দেশের কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে কয়লার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করে। আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম বেড়ে গেলেও সরকার নির্দিষ্ট অর্থের বেশি টাকা প্রদান করে না।
কিন্তু আদানির সাথে চুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে। গোডা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লার দাম আন্তর্জাতিক বাজার দর অনুযায়ী পরিশোধ করার চুক্তি করেছিল। যদিও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে কয়লার দাম প্রায় তিন গুন বেড়েছে। তারপরও কয়লা সরবরাহে খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না। কারণ ভারতের ৩৬গড়, ঝাড়খন্ড এবং উড়িষ্যা রাজ্যে আধুনিক রুপের বিশাল বিশাল কয়লার খনি আছে। এমনকি ভারতে কয়লা উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া ছয়টি খনির মধ্যে ৪টি খনির ঠিকাদারি পেয়েছে আদানির কোম্পানি।
শুধু তাই নয় অস্ট্রেলিয়ার কোইন্সল্যান্ডে থাকা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কয়লা খনি ও আদানি গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আদানি গ্রুপের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে তারা বছরে 9 কোটি টন কয়লা উৎপাদন করতে পারে। এবং আগামী ৩০ বছরে তারা ৩০০ কোটি টন কয়লা মজুদ করার সক্ষমতা রাখে। গ্লোবাল এনার্জি মনিটরের তথ্য মতে গৌতম আদানীর কোম্পানি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে ব্যক্তিগত কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং কয়লা খনির মালিক।
ভারতে এত কয়লার মালিকানা থাকার পরও আদানি পাওয়ার চুক্তিতে দেখিয়েছে যে তারা প্রতিবছর ৭০ লক্ষ টন কয়লা বিদেশ থেকে আমদানি করবে। এত বিপুল পরিমাণ কয়লা বিদেশ থেকে আমদানি করলে সভাবতই তার দাম বেশি পড়বে। কিন্তু সেখানেও আদানি গ্রুপই লাভবান হবে। কারণ অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা বিদেশি কয়লার মালিকও আদানি নিজেই। সেই সাথে কয়লা আবার যে বন্দরে খালাস করা হবে সেই সমুদ্রবন্দরও আদানির মালিকানাধীন। পরিবহনের জন্য যে রেললাইন ব্যবহার করা হবে সেই রেললাইনও আদানিরই তৈরি করা।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে আদানি গ্রুপ প্রতি টন কয়লার দাম ধরেছে ৪০০ ডলার। অথচ বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ চীনের যৌথ বিনিয়োগের করা পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লার দাম পরেছে প্রতি টন ২৫০ ডলারের মত। আদানী প্রতিজন কয়লার যে দাম প্রস্তাব করেছিল তার রামপাল ও পায়রার চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি। আদানের কয়লার দাম বেশি হবার কারণে বাংলাদেশ উৎপাদন করলে যে বিদ্যুতের দাম হত ১৩ থেকে ১৪ টাকা আধানীর কাছ থেকে তা ২২ টাকায় কিনতে হচ্ছে। বাংলাদেশ যদি আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ না কিনে, সেক্ষেত্রেও প্রতিবছর আদানিকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। বাংলাদেশী টাকায় যার মূল্য ৪,৭৮১ কোটি টাকা।

তার মানে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনা বাদ দিলেও ২০৪৫ সাল পর্যন্ত, প্রতিবছর প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা আদানিকে দিয়ে যেতে হবে। ডলারের দাম বাড়লে এই টাকা আরো বাড়বে। আগামী ২৫ বছর আদানিকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিলে তার পরিমাণ দাঁড়াবে ১ লক্ষ ২৫ হাজার কোটি টাকারও অনেক বেশি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা ওয়াশিংটন পোস্ট কে বলেছিল বাংলাদেশের সাথে করা আদানির এই চুক্তিটি অবশ্যই প্রতারণা। আর বাংলাদেশের পক্ষে এই চুক্তির বৈধতা দিয়ে দেশের জনগণনের সাথে চূড়ান্ত পর্যায়ের বিশ্বাসঘাতকতার কাজটি করেছে, শেখ হাসিনার জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক ইলাহী। আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হলেও। শেখ হাসিনার মাফিয়া সরকারের লোকজন ব্যক্তিগত ভাবে লাভবান হয়েছে।

শেখ হাসিনার আমলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গিয়ে বাংলাদেশ চরম আর্থিক সংকটে পড়েছিল। সে কারণেই হয়তো দীর্ঘদিন আদানির বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধ করা থেকে বিরত ছিল হাসিনা সরকার। বর্তমানে বাংলাদেশের তীব্র বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে। আদানি পাওয়ারের মোটা অংকের দেনা করার বিষয়টি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বারতি মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শেখ হাসিনা শুধু আদানির কাছ থেকেই নয়। ভারতের বেশ কয়েকটি সরকারি বিদ্যুৎ সংস্থার কাছ থেকেও বিদ্যুৎ আমদানি করেছে। সব মিলিয়ে ভারতের কাছে বাংলাদেশের বকেয়ার পরিমাণ ১০০ কোটি ডলার বা এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশী টাকায় যার মূল্য ১১,৯৫৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু আদানির কাছেই বকেয়া আছে ৮০০ মিলিয়ন ডলার বা ৯ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা।
আদানি পাওয়ার ইতোমধ্যেই প্রধান উপদেষ্টা ডঃ মোঃ ইউনূসের কাছে চিঠি লিখে এই টাকা পরিশোধ করার তাগাদা দিয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের একটি অংশ এখনই পরিশোধ না করলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংকট আরো তীব্র হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ ইতোমধ্যেই আদানি অন্তত ৫০০ মেগাওয়া বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে।
ভারতের আদানি গ্রুপ বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত একটি প্রতারক প্রতিষ্ঠান। ২০২৩ সালে মার্কিন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান হিন্দেন বার্গ রিসার্চ আদানি গ্রুপের কর্পোরেট জালিয়াতি প্রকাশ করার পর। আদানি রাতারাতি ১০০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ হারিয়েছিল। অতীতে কয়লা খনি কেলেঙ্কারির কারণে অস্ট্রেলিয়ার জনগণ আদানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে কেনিয়ায়ও বিমানবন্দর কেলেঙ্কারিতে আদানি গ্রুপ নিন্দিত হয়েছে।
সেই আদানির সাথে হাসিনা সরকার বাংলাদেশের টাকা দিয়ে ভারতের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি দামে বিদ্যুৎ আমদানি করার অন্যাজো চুক্তি করেছিল। বাংলাদেশের জনগণকে না জানিয়ে, গোপনে এমন প্রতারণামূলক চুক্তি সই করা প্রকৃতপক্ষে দেশ বিক্রি করে দেওয়ারই নামান্তর।

লেখক থেকে আরো

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

Advertismentspot_img

সাম্প্রতিক সংবাদ

আরও কত বছর চাপে থাকবে বাংলাদেশের অর্থনীতি?

বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও এক বছর চাপে থাকবে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন জিডিপি কমে ৪ শতাংশ হবে। তবে...

ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমছে কেন?

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমছে। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, টাকার মান কমে যাওয়ার পেছেনে বেশ কিছু...

প্যারিসে গাড়ির প্রদর্শনীতে চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ির আধিপত্য

চীনা পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে বরাবরই শুল্ক আরোপের চর্চা অব্যাহত রেখেছে পশ্চিমা বিশ্ব। এই ধারাবাহিকতায় চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানিতে আগামী পাঁচ বছরে শুল্ক ১০...

সর্বশেষ খবরের সাথে আপ টু ডেট থাকতে চান?

আমরা আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই! আপনার বিবরণ পূরণ করুন এবং আমরা আমাদের সকল আপডেট আপনাকে জানাবো।