পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল কিংবা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে – বিগত কয়েক বছরে এই শব্ধগুলোর যেন হয়ে গেছে আমাদের নিত্য সঙ্গী। মেগাপ্রকল্পে ভর করে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছিল বাজারদর, সামাজিক বৈষম্য কিংবা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের জীবন। বাংলাদেশের কিছু মেগাপ্রকল্প যেন আলোর মুখ দেখিয়েছে, বদলে দিয়েছে লাখ মানুষের জীবন- ঠিক তেমনি কিছু প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে চরমভাবে। দেশের ব্যাপক আর্থিক অপচয় আর মোটা অংকের ঋণের বোঝায় এসব প্রকল্প এখন যেন গলার কাঁটা।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট তৈরি করেছে ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ২০১৮ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎপেক্ষণ করা হয়। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইটের ক্লাবে যুক্ত হয় বাংলাদেশ। তখন সরকারের পক্ষ থেকে স্যাটেলাইটটির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়সহ নানা সুফলের কথা বলা হয়েছিল। অপরদিকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন কেউ কেউ।
উৎক্ষেপণের ৬ বছর পেরিয়ে বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি । বছরে ১৮৬ কোটি টাকা অবচয়ের বিপরিতে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের আয় ৮৫ কোটি টাকা। ফলে এর লোকসান দারায় বছরে ৬৬ কোটি টাকা। এদিকে এই স্যাটেলাইটের মেয়াদই ১৫ বছর। যেখানে ইতিমধ্যেই শেষ ছয় ৬ বছর। আর বাকি ৯ বছরে অতীতের সব ক্ষতি পুষিয়ে। এই প্রকল্প কি লাভের মুখ দেখবে বলে মনে করেন?
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। উদ্বোধন করা হয় ২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর। পরদিন থেকে শুরু হয় যান চলাচল। এই টানেলটি বাংলাদেশের প্রথম সুরঙ্গ পথ। এবং দক্ষিণ এশিয়ার নদীর তলদেশে প্রথম এবং দীর্ঘতম সুরঙ্গপথ। এই টানেলটি নির্মাণের ব্যয় হয় ১০,৬৮৯ কোটি টাকা। তবে বর্তমানে আয় এর তুলনায় এই প্রকল্পের ব্যয় দৈনিক ২৫ লাখ টাকার বেশি। গরে দিনে প্রায় ৪ হাজার যানবাহন চলাচল করছে এই টানেলে। টোল বাবুর দৈনিক আয় হচ্ছে প্রায় ১২ লাখ টাকা। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ বাবত দৈনিক খরচ 37 লাখ টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন পুরো প্রকল্পটি নির্মাণে ছিল না কোন পরিকল্পনা। এটিকে বিলাসিতা উল্লেখ করে অর্থের অপচয় এবং লুৎপাতের প্রকল্প বলে আখ্যায়িত করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে, মাতারবাড়ির ১ হাজার ৬০০ একরের পরিত্যক্ত লবণ উৎপাদনের মাঠে, নির্মাণ করা হয়েছে। দেশের বৃহৎ ১২০০ মেগাওয়াট ধারণক্ষমতার মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৫১ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। অথচ এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে মাত্র ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন দুটি প্লান্ট করা হয়েছে। যা কোনভাবেই এর ব্যায়ের সাথে যৌক্তিক নয়। দুটি ইউনিক নিয়ে ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের খরচ যা রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয়ের তিনগুণ ও পায়রা বিদ্যুৎ প্রকল্পের আড়াই গুণের বেশি।
পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রথম পরিকল্পনা করা হয় পাকিস্তানি শাসনামলে। কিন্তু , নানা প্রতিকূলতায় যেটি পরবর্তীতে বাস্তবায়িত হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। রাশিয়ার সহযোগিতায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে তোড়জোড় শুরু হয়।
রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে প্রথম এবং প্রধান আশঙ্কা হল এর পারমাণবিক দুর্ঘটনার ঝুঁকি। এমনিতে পারমানবিক প্রযুক্তি শতভাগ নিরাপদ কোন প্রযুক্তি নয়। তার উপর বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও পারমাণবিক প্রযুক্তিতে নিজস্ব সক্ষমতাহীন একটি দেশে। স্রেফ আমদানি করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা মানে হলো। পারমাণবিক প্রযুক্তির স্বাভাবিক ঝুঁকির উপর, বাড়তি ঝুঁকি, বাংলাদেশের জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া।
চেরনোবিল, থ্রি মাই আইল্যান্ডস। কিংবা সর্বশেষ ফূকুসিমার মতো বড় বড় দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে। প্রযুক্তির দিক থেকে শীর্ষ অবস্থানকারী দেশগুলোয়। যারা নিজস্ব দক্ষতাকে কেন্দ্র করে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেছিল।
আর সেখানে আমাদের মত দেশে। যেখানে কল-কারখানা থেকে শুরু করে। সড়ক- মহাসড়ক সর্বত্র দুর্ঘটনা প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা প্রকট। সেখানে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো। একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল প্রযুক্তি। মূলত বিদেশীদের উপর নির্ভর করে , পরিচালনা করা। বাড়তি ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
পারমাণবিক প্রযুক্তি আধুনিক বিশ্বের, একটি নতুন সংযোজন হলেও এতে রয়েছে ব্যাপক ঝুঁকি। যেসব দেশ পারমাণবিক অস্ত্র আবিষ্কার করেছে। এসব অস্ত্র, বর্তমানে এর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের জন্য , একটি লস প্রজেক্ট হিসেবেই ধরা দিচ্ছে