আজকের বাংলাদেশে সাধারণ সৌজন্যবোধের অভাবটা বড্ড প্রকট। অধিকাংশ মানুষের মনোভাবটা যেন ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচ্যগ্র মেদিনী’। সারিবদ্ধভাবে লিফটে ওঠা একটি সাধারণ ভদ্রতা। তবে এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়, যাঁরা এই ভদ্রতার ধারও ধারেন না। কেউ একটি সারির পাশে করেন নতুন সারি, কেউ কেউ আবার সারিবদ্ধতার ‘ঝামেলা’তেই যান না। কার আগে কে যাবেন, সে প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন। ‘অসুস্থ বা বয়স্ক ব্যক্তিকে আগে যেতে দেওয়া একটি মানবিক আচরণ। অথচ শিষ্টাচারবহির্ভূত এ কাজ আমরা প্রায়ই করে থাকি। আসলে এমন আচরণ করা কখনোই উচিত নয়, অন্য কেউ যে আচরণ করলে আপনি বিরক্ত হতেন,’ বলছিলেন ঢাকার গভর্নমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লায়েড হিউম্যান সায়েন্সের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাসমিয়া জান্নাত। তাঁর কাছ থেকে জেনে নেওয়া যাক লিফটের শিষ্টাচার—
ওঠানামার সময়
- সারিবদ্ধভাবে লিফটে উঠতে হবে। সারিটি এমন হতে হবে, যাতে লিফট থেকে বের হওয়ার জন্য পাশে পর্যাপ্ত জায়গা থাকে। তবে কেউ জরুরি পরিস্থিতিতে পড়লে তাঁকে আগে যেতে দিন। বয়োজ্যেষ্ঠ ও অসুস্থ ব্যক্তিদের বেলাতেও একই কথা প্রযোজ্য।
- লিফটে উঠেই কাঙ্ক্ষিত তলার বোতামে চাপ দেওয়ার জন্য লিফটের দরজার দিকটা আটকে দাঁড়াবেন না; বরং লিফটে উঠে ভেতর দিকে চলে যান, লিফট পূর্ণ হয়ে এলে দরজার কাছে থাকা ব্যক্তিদের কাউকে আপনার কাঙ্ক্ষিত সংখ্যাটিতে চাপ দেওয়ার অনুরোধ করুন।
- আগে নামবেন—এ বিবেচনা থেকে কেউ কেউ লিফটে উঠেই দরজার কাছে দাঁড়ান। এ কাজ করবেন না, এতে অন্যরা অসুবিধায় পড়েন।
- ধারণক্ষমতার বেশি মানুষ উঠে পড়লে শেষে ওঠা ব্যক্তিকেই নামতে হবে। অযথা অন্যকে সামনে-পেছনে বা ডানে-বাঁয়ে চেপে দাঁড়াতে বলবেন না।
- কারও নামার সময় লিফটের সামনের অংশ থেকে একাধিক ব্যক্তিকে নামতে হতে পারে। এতে বিরক্তি প্রকাশ করবেন না। লিফটের ভেতরে আপনি একটু সরে দাঁড়ালেই যে পেছনের বা পাশের ব্যক্তি স্বচ্ছন্দে নামতে পারবেন, তা নয়। প্রয়োজনে নেমে দাঁড়ানোটাই প্রকৃত সৌজন্যবোধ।
সাধারণ আদব
- জুতায় ময়লা থাকলে লিফটে ওঠার আগেই পাপোশে মুছে নিন।
- লিফটে ময়লা ফেলবেন না। কাগজের টুকরাও নয়।
- লিফটে কোনো পানীয়র বোতল মুখ খোলা অবস্থায় রাখবেন না। খাওয়াদাওয়া করাও উচিত নয়।
- পরিচিত কেউ এসে আপনার সঙ্গে লিফটে উঠবে, সেই অপেক্ষায় লিফট আটকে রাখবেন না। প্রয়োজনে আপনি তাঁর সঙ্গে পরে আসুন।
- লিফটে উচ্চ স্বরে কথা বলবেন না বা অডিও ক্লিপ চালাবেন না। লিফটে ফোনের কথা কেটে যেতে পারে, তাই কথা না বলাই ভালো।
- পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে লিফটে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে তাঁকে জড়িয়ে ধরা বা হইচই না করাই ভালো।
- লিফটে ওঠার আগে ভেতরের মানুষদের নামতে দিন।
- ওপরে ওঠার জন্য কেবল ওপরের দিকনির্দেশিত বোতাম চাপ দিন। নিচে নামার জন্য কেবল নিচে নির্দেশিত বোতাম চাপুন।
- ভুল করে হয়তো লিফটে করে নিচে চলে এসেছেন, তাই সেই লিফটেই ওপরে যাবেন। এমন হলে অপেক্ষমাণ মানুষদের জানিয়ে দিন, আপনি নামছেন না। তাহলে আপনি নামবেন কি না, এ নিয়ে তাঁরা দ্বিধায়
পড়বেন না। - মাত্র দু–একতলা ওঠা বা নামার জন্য কেউ কেন লিফটে ওঠে, এমন তির্যক মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুন। ওই ব্যক্তি সিঁড়িভাঙার জন্য শারীরিকভাবে সক্ষম কি না, তা কিন্তু আপনি জানেন না।
- লিফটের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী হয়তো আরেকজন লিফটে উঠতে পারবেন। কিন্তু আরেকজন উঠলে লিফটে থাকা কোনো নারীর সঙ্গে ভদ্রতাসূচক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হবে না মনে হলে সেই লিফটে না ওঠাই ভালো। অন্তঃসত্ত্বাকে জায়গা ছেড়ে দিন।
স্থানভেদে আরও কিছু বিষয় খেয়াল রাখা উচিত—
আবাসিক ভবনের লিফটে
- বাজারসদাই কিংবা বাড়ির ময়লা আনা-নেওয়ার সময় খেয়াল রাখুন, যাতে লিফটে কিছু না পড়ে। মাছ-মাংসের রক্ত বা এ–জাতীয় কিছু লেগে গেলে নিজেরাই মুছে ফেলার ব্যবস্থা করুন।
- অফিস বা স্কুল শুরু কিংবা শেষের সময় বাড়ির মালামাল কিংবা ময়লা লিফটে বহন না করে আগে বা পরের সময়টাকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করুন। ময়লার থলের মুখ আটকে দিন।
- পরিচিত বা অপরিচিত বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে সম্ভাষণ জানান। তিনি হয়তো একই ভবনের বাসিন্দা কিংবা অতিথি। ছোট শিশুর সঙ্গেও মিষ্টি আলাপ চালাতে পারেন। এসবই আপনার সৌজন্যবোধের পরিচয়।
কর্মস্থলের লিফটে
নির্দিষ্ট কিছু সময় খুব ভিড় হয়। হুড়োহুড়ি না করে সৌজন্যবোধের পরিচয় দিন। কার্ড ‘পাঞ্চ’ করতে দেরি হলে মুশকিল? তাহলে বরং কিছুটা আগেই কর্মস্থলে পৌঁছাতে চেষ্টা করুন। ‘বস’ একই লিফটে? তাঁকে জায়গা দিতে গিয়ে অন্য কাউকে ধাক্কা দেবেন না যেন।
দোকানপাটের লিফটে
আপনার হাতভর্তি ব্যাগের জন্য অন্যের অসুবিধা হতে পারে। তাই ব্যাগগুলোকে এক পাশে রেখে অন্যদের যথাসম্ভব জায়গা দিন। কারও হাতে ভঙ্গুর জিনিস থাকলে কিংবা হাতবোঝাই মালামাল থাকলে তাঁকে সাহায্য করুন। অনেক জায়গাতেই চলন্ত সিঁড়ি থাকে। ভিড় এড়াতে দু–একতলা ওঠানামার জন্য এগুলো ব্যবহার করতে পারেন।
হাসপাতালের লিফটে
- অসুস্থ ব্যক্তি এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের আগে সুযোগ দিন। জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির স্বজনেরা জরুরি ফোন পেয়ে লিফটে উঠছেন, এমনটা বুঝলে তাঁদেরও আগে যেতে দেওয়া উচিত। কেউ রক্তদাতা হিসেবে নিজের পরিচয় দিলে তাঁকেও জায়গা ছেড়ে দিন।
- রোগী বা স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য আলাদা লিফট থাকলে সেটাতে ওঠার জন্য জবরদস্তি করবেন না।
- হয়তো লিফটের জন্য অপেক্ষা করার সময় নেই। লিফট ‘কল’ দিয়ে দুই মিনিট বাদে সিঁড়ি দিয়েই হেঁটে গেলেন। এ ক্ষেত্রে আগে কলটি বাতিল করুন।