বিএনপি গণঅভ্যুত্থান থেকে যেভাবে লাভবান

বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে তিনটি বড় গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনীতির বাঁক বদল ঘটেছে, তার সবগুলোতে দৃশ্যত লাভবান হয়েছে বিএনপি। এই তিনটি ঘটনা ঘটেছে ১৯৭৫ সাল, ১৯৯০ সাল এবং ২০২৪ সালে।
এসব গণঅভ্যুত্থানের একটির মাধ্যমে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছেন, আরেকটি গণঅভ্যুত্থানের পরে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে এবং আরেকটির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
বিএনপি কেন এবং কীভাবে এসব গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে ?
দুটো গণঅভ্যুত্থানের পরে ‘রাজনৈতিক শূন্যতার’ সুবিধা পেয়েছে বিএনপি। প্রতিটি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত নেতিবাচক হিসেবে জনগণের কাছে প্রতিভাত হয়েছে। সে সুযোগ বিএনপি পেয়েছে। জন-বিদ্রোহ বা জনরোষের ফলে যে সরকার পরিবর্তন হয়েছে, সেটার রাজনৈতিক ফসল বিএনপি ঘরে তুলেছে।
সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান ১৯৭৫
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার আগে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অনেকের মনে মারাত্মক অসন্তোষ ছিল।
একদলীয় শাসন ব্যবস্থা, যেটি ‘বাকশাল’ হিসেবে পরিচিত, প্রবর্তনের মাধ্যমে মুজিব-বিরোধী মনোভাব প্রবল হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ তখন অত্যন্ত নেতিবাচক হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর তৎকালীন বাংলাদেশে পরিষ্কার রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। সেটি পূরণ করার জন্য ‘বিশ্বাসযোগ্য ও জনপ্রিয়’ কোনো দল ছিল না। যেসব রাজনৈতিক দল ছিল, তাদের জনভিত্তি ততটা শক্ত ছিল না।


হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে বিএনপি নামক কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ছিল না। তখন ক্ষমতায় এসেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ, যিনি আওয়ামী লীগেরই নেতা ছিলেন।
তবে সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে জিয়াউর রহমান সেনানিবাসের বাইরেও অনেকের কাছে পরিচিত ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে বিদ্রোহ হয়। খালেদ মোশাররফের এই অভ্যুত্থানকে ভারতীয় আধিপত্যবাদের একটি ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করে মুজিব-বিরোধীরা। ভারতীয় চক্রান্তের গুজব ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে দুঃশ্চিন্তা এবং সন্দেহ দেখা দেয়।
৭ নভেম্বর দেশের বিভিন্ন সেনা ছাউনি থেকে সৈন্যরা ঢাকায় এসে পৌঁছায় এবং তাদের সঙ্গে স্বতঃ:স্ফূর্তভাবে হাজার হাজার জনতা যোগ দেয়।
এ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিল তৎকালীন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও জাসদ নেতা কর্নেল আবু তাহের। প্রধানত তার পরিকল্পনায় জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়। তখন অনেকের ধারণা হয়েছিল যে আওয়ামী লীগ হয়তো ভারতের সহায়তা নিয়ে আবার ফিরে আসতে পারে। সেই আশঙ্কা কিংবা প্রেক্ষাপট থেকে ৭ নভেম্বর কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহী-জনতা বিদ্রোহ করে এবং জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে। ক্যান্টনমেন্টে আবু তাহেরের নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকলেও বাইরে সিপাহী-জনতার মিছিল এবং বিক্ষোভ সকাল ১০টার আগেই জাসদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
সিপাহী-জনতা জিয়া এবং মোশতাকের নামে স্লোগান দিয়ে ঢাকা শহরকে কাঁপিয়ে তোলে। সেদিন রাজধানীতে সিপাহী-জনতার বিপ্লব ঘটে এবং ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত ভারত এবং আওয়ামী বিরোধী মনোভাবেরই বহি:প্রকাশ দেখা যায়।
এরপর বন্দিদশা থেকে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন। ৭ নভেম্বরের পর থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালিত হয় জিয়াউর রহমানের ইশারায়। কিন্তু জিয়াউর রহমান মুক্ত হবার পর পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। যে জিয়াউর রহমানকে পাশে পাবার আশায় ছিলেন কর্নেল তাহের, সে জিয়াউর রহমান মুক্ত হয়ে ভিন্ন ইঙ্গিত দিলেন।
দৃশ্যপটের সামনে চলে আসেন জিয়াউর রহমান এবং আড়ালে যেতে থাকেন কর্নেল তাহের। খন্দকার মোশতাক ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম।
তিনি প্রেসিডেন্ট থাকলেও ক্ষমতা পরিচালিত হতো ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিয়াউর রহমানের নির্দেশনায়।
১৯৭৬ সালে জুলাই মাসে কর্নেল তাহেরসহ ১৭ জনকে সামরিক আদালতে গোপন বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল। বিচারের কয়েকদিন পরেই কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।
১৯৭৬ সালের নভেম্বর মাসে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ থেকে সরে যান আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। তখন জিয়াউর রহমানের হাতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব জিয়াউর রহমানের কাছে দিয়ে পদত্যাগ করেন।
রাষ্ট্রপতি হবার দেড় বছরের মধ্যে রাজনৈতিক দল গঠন করেন জিয়াউর রহমান।
গণঅভ্যুত্থান ১৯৯০
১৯৮০’র দশকে তৎকালীন সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আন্দোলন করে। তাদের সাথে অন্যান্য রাজনৈতিক দলও ছিল।
এরশাদের পতনের পরে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে যখন প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তখন ক্ষমতায় আসে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি।
এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেবার কারণে জনগণের মধ্যে তাদের নিয়ে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়।
তখন এরশাদ-বিরোধী বড় রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছিল যে স্বৈরাচার সরকারের আমলে কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। কিন্তু সবাইকে হতবাক করে দিয়ে আওয়ামী লীগ ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।
নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে এইচএম এরশাদ সরকারের সঙ্গে তাদের একটি সমঝোতা হয়েছিল বলে জানা যায়। তখন এরশাদ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন মওদুদ আহমদ, যিনি পরবর্তীতে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন।
বিএনপি তখন একটা ধারণা তৈরি করতে পেরেছিল যে আওয়ামী লীগ যদি ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ না নিত তাহলে এরশাদের পতন আরও আগেই ঘটানো সম্ভব হতো।
‘এ বিষয়টি বিএনপিকে রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছিল এরশাদের পতনের পর। এর ফলে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি ক্ষমতায় আসে।
একদিকে এরশাদের সঙ্গে সমঝোতা করে আওয়ামী লীগ ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, অন্যদিকে জেনারেল এরশাদ বিএনপিকে ভাঙার জন্য চেষ্টা করেছেন এবং বিএনপি থেকে একটি অংশকে বের করে এনেছিলেন।
‘খালেদা জিয়া নেতা হয়েছিলেন এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তিনি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী হিসেবে নেতা হন নাই।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ২০২৪
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার পরে যে দুটো রাজনৈতিক দল এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে লাভবান হয়েছে তারা হচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী।
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার পরে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ স্বয়ংক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের দখলে চলে গেছে।
৫ আগস্টের পরে বেশ দ্রুততার সঙ্গে বিএনপি নেতা খালেদা জিয়াকে মুক্তির আদেশে স্বাক্ষর করে রাষ্ট্রপতি। এরপর বিএনপির বেশ কিছু সিনিয়র নেতা জেল থেকে দ্রুত ছাড়া পান। অনেকে কিছু মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।
লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপি নেতা তারেক রহমানের বক্তব্য শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে গণমাধ্যমে প্রচার করা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারিত হচ্ছে।
মাঠ পর্যায়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের এখন আর পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে না। এসব কিছু বিএনপিকে তাৎক্ষনিকভাবে রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছে।
গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের শাসনামলকে ‘ফ্যাসিবাদের’ তুলনা করেছে বিএনপি। ৫ই অগাস্ট শেখ হাসিনার পতন ও ভারতে পালিয়ে যাবার পরে বিএনপির দেয়া ‘ফ্যাসিবাদ’ তকমা অনেকেই ব্যবহার করছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে।
১৯৭৫ সাল এবং ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ নেতিবাচক হিসেবে উপস্থিতি হয়েছে জনগণের সামনে। এর রাজনৈতিক সুবিধা খুব স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের হাতে চলে গেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মানুষ আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে বরাবর বিএনপিকেই দেখেছে।
বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের বাইরে যদি আরেকটি কার্যকরী শক্তি থাকতো তাহলে বিএনপি হয়তো বা এই সুবিধা পেতো না।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে তিনটি বড় গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনীতির বাঁক বদল ঘটেছে, তার সবগুলোতে দৃশ্যত লাভবান হয়েছে বিএনপি। এই তিনটি ঘটনা ঘটেছে ১৯৭৫ সাল, ১৯৯০ সাল এবং ২০২৪ সালে।
এসব গণঅভ্যুত্থানের একটির মাধ্যমে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছেন, আরেকটি গণঅভ্যুত্থানের পরে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে এবং আরেকটির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
বিএনপি কেন এবং কীভাবে এসব গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে ?
দুটো গণঅভ্যুত্থানের পরে ‘রাজনৈতিক শূন্যতার’ সুবিধা পেয়েছে বিএনপি। প্রতিটি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত নেতিবাচক হিসেবে জনগণের কাছে প্রতিভাত হয়েছে। সে সুযোগ বিএনপি পেয়েছে। জন-বিদ্রোহ বা জনরোষের ফলে যে সরকার পরিবর্তন হয়েছে, সেটার রাজনৈতিক ফসল বিএনপি ঘরে তুলেছে।
সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান ১৯৭৫
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার আগে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অনেকের মনে মারাত্মক অসন্তোষ ছিল।
একদলীয় শাসন ব্যবস্থা, যেটি ‘বাকশাল’ হিসেবে পরিচিত, প্রবর্তনের মাধ্যমে মুজিব-বিরোধী মনোভাব প্রবল হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ তখন অত্যন্ত নেতিবাচক হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর তৎকালীন বাংলাদেশে পরিষ্কার রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। সেটি পূরণ করার জন্য ‘বিশ্বাসযোগ্য ও জনপ্রিয়’ কোনো দল ছিল না। যেসব রাজনৈতিক দল ছিল, তাদের জনভিত্তি ততটা শক্ত ছিল না।


হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে বিএনপি নামক কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ছিল না। তখন ক্ষমতায় এসেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ, যিনি আওয়ামী লীগেরই নেতা ছিলেন।
তবে সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে জিয়াউর রহমান সেনানিবাসের বাইরেও অনেকের কাছে পরিচিত ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে বিদ্রোহ হয়। খালেদ মোশাররফের এই অভ্যুত্থানকে ভারতীয় আধিপত্যবাদের একটি ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করে মুজিব-বিরোধীরা। ভারতীয় চক্রান্তের গুজব ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে দুঃশ্চিন্তা এবং সন্দেহ দেখা দেয়।
৭ নভেম্বর দেশের বিভিন্ন সেনা ছাউনি থেকে সৈন্যরা ঢাকায় এসে পৌঁছায় এবং তাদের সঙ্গে স্বতঃ:স্ফূর্তভাবে হাজার হাজার জনতা যোগ দেয়।
এ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিল তৎকালীন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও জাসদ নেতা কর্নেল আবু তাহের। প্রধানত তার পরিকল্পনায় জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়। তখন অনেকের ধারণা হয়েছিল যে আওয়ামী লীগ হয়তো ভারতের সহায়তা নিয়ে আবার ফিরে আসতে পারে। সেই আশঙ্কা কিংবা প্রেক্ষাপট থেকে ৭ নভেম্বর কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহী-জনতা বিদ্রোহ করে এবং জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে। ক্যান্টনমেন্টে আবু তাহেরের নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকলেও বাইরে সিপাহী-জনতার মিছিল এবং বিক্ষোভ সকাল ১০টার আগেই জাসদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
সিপাহী-জনতা জিয়া এবং মোশতাকের নামে স্লোগান দিয়ে ঢাকা শহরকে কাঁপিয়ে তোলে। সেদিন রাজধানীতে সিপাহী-জনতার বিপ্লব ঘটে এবং ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত ভারত এবং আওয়ামী বিরোধী মনোভাবেরই বহি:প্রকাশ দেখা যায়।
এরপর বন্দিদশা থেকে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন। ৭ নভেম্বরের পর থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালিত হয় জিয়াউর রহমানের ইশারায়। কিন্তু জিয়াউর রহমান মুক্ত হবার পর পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। যে জিয়াউর রহমানকে পাশে পাবার আশায় ছিলেন কর্নেল তাহের, সে জিয়াউর রহমান মুক্ত হয়ে ভিন্ন ইঙ্গিত দিলেন।
দৃশ্যপটের সামনে চলে আসেন জিয়াউর রহমান এবং আড়ালে যেতে থাকেন কর্নেল তাহের। খন্দকার মোশতাক ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম।
তিনি প্রেসিডেন্ট থাকলেও ক্ষমতা পরিচালিত হতো ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিয়াউর রহমানের নির্দেশনায়।
১৯৭৬ সালে জুলাই মাসে কর্নেল তাহেরসহ ১৭ জনকে সামরিক আদালতে গোপন বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল। বিচারের কয়েকদিন পরেই কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।
১৯৭৬ সালের নভেম্বর মাসে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ থেকে সরে যান আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। তখন জিয়াউর রহমানের হাতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব জিয়াউর রহমানের কাছে দিয়ে পদত্যাগ করেন।
রাষ্ট্রপতি হবার দেড় বছরের মধ্যে রাজনৈতিক দল গঠন করেন জিয়াউর রহমান।
গণঅভ্যুত্থান ১৯৯০
১৯৮০’র দশকে তৎকালীন সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আন্দোলন করে। তাদের সাথে অন্যান্য রাজনৈতিক দলও ছিল।
এরশাদের পতনের পরে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে যখন প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তখন ক্ষমতায় আসে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি।
এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেবার কারণে জনগণের মধ্যে তাদের নিয়ে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়।
তখন এরশাদ-বিরোধী বড় রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছিল যে স্বৈরাচার সরকারের আমলে কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। কিন্তু সবাইকে হতবাক করে দিয়ে আওয়ামী লীগ ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।
নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে এইচএম এরশাদ সরকারের সঙ্গে তাদের একটি সমঝোতা হয়েছিল বলে জানা যায়। তখন এরশাদ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন মওদুদ আহমদ, যিনি পরবর্তীতে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন।
বিএনপি তখন একটা ধারণা তৈরি করতে পেরেছিল যে আওয়ামী লীগ যদি ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ না নিত তাহলে এরশাদের পতন আরও আগেই ঘটানো সম্ভব হতো।
‘এ বিষয়টি বিএনপিকে রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছিল এরশাদের পতনের পর। এর ফলে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি ক্ষমতায় আসে।
একদিকে এরশাদের সঙ্গে সমঝোতা করে আওয়ামী লীগ ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, অন্যদিকে জেনারেল এরশাদ বিএনপিকে ভাঙার জন্য চেষ্টা করেছেন এবং বিএনপি থেকে একটি অংশকে বের করে এনেছিলেন।
‘খালেদা জিয়া নেতা হয়েছিলেন এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তিনি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী হিসেবে নেতা হন নাই।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ২০২৪
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার পরে যে দুটো রাজনৈতিক দল এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে লাভবান হয়েছে তারা হচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী।
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার পরে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ স্বয়ংক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের দখলে চলে গেছে।
৫ আগস্টের পরে বেশ দ্রুততার সঙ্গে বিএনপি নেতা খালেদা জিয়াকে মুক্তির আদেশে স্বাক্ষর করে রাষ্ট্রপতি। এরপর বিএনপির বেশ কিছু সিনিয়র নেতা জেল থেকে দ্রুত ছাড়া পান। অনেকে কিছু মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।
লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপি নেতা তারেক রহমানের বক্তব্য শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে গণমাধ্যমে প্রচার করা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারিত হচ্ছে।
মাঠ পর্যায়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের এখন আর পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে না। এসব কিছু বিএনপিকে তাৎক্ষনিকভাবে রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছে।
গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের শাসনামলকে ‘ফ্যাসিবাদের’ তুলনা করেছে বিএনপি। ৫ই অগাস্ট শেখ হাসিনার পতন ও ভারতে পালিয়ে যাবার পরে বিএনপির দেয়া ‘ফ্যাসিবাদ’ তকমা অনেকেই ব্যবহার করছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে।
১৯৭৫ সাল এবং ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ নেতিবাচক হিসেবে উপস্থিতি হয়েছে জনগণের সামনে। এর রাজনৈতিক সুবিধা খুব স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের হাতে চলে গেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মানুষ আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে বরাবর বিএনপিকেই দেখেছে।
বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের বাইরে যদি আরেকটি কার্যকরী শক্তি থাকতো তাহলে বিএনপি হয়তো বা এই সুবিধা পেতো না।

লেখক থেকে আরো

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

Advertismentspot_img

সাম্প্রতিক সংবাদ

আরও কত বছর চাপে থাকবে বাংলাদেশের অর্থনীতি?

বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও এক বছর চাপে থাকবে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন জিডিপি কমে ৪ শতাংশ হবে। তবে...

ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমছে কেন?

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমছে। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, টাকার মান কমে যাওয়ার পেছেনে বেশ কিছু...

প্যারিসে গাড়ির প্রদর্শনীতে চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ির আধিপত্য

চীনা পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে বরাবরই শুল্ক আরোপের চর্চা অব্যাহত রেখেছে পশ্চিমা বিশ্ব। এই ধারাবাহিকতায় চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানিতে আগামী পাঁচ বছরে শুল্ক ১০...

সর্বশেষ খবরের সাথে আপ টু ডেট থাকতে চান?

আমরা আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই! আপনার বিবরণ পূরণ করুন এবং আমরা আমাদের সকল আপডেট আপনাকে জানাবো।